রোহিঙ্গা ডাকাত বাহিনী বেপরোয়া

আবদুর রহমান ◑
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সুযোগ নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন পাহাড়গুলোতে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিছু ডাকাতদল। দস্যুতা, স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ,হত্যাসহ নানা অপরাধের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি তারা তুলে নিয়ে গেছে স্থানীয় তিন বাংলাদেশি কৃষককে। মুক্তিপণ না পেয়ে এদের একজনকে হত্যা ও অপর দুজনের বাড়িতে মুক্তিপণ চেয়ে না দিলে হত্যার হুমকি পাঠিয়েছে ডাকাত দলের সদস্যরা। পুলিশ এদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেও কিছু রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের সহযোগিতা পাওয়ায় তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না।

স্থানীয়রাসহ রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছে, পাহাড়ে আশ্রয়স্থল বানিয়ে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ও মানবপাচার করছে এসব ডাকাত দল। তবে তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করছে। আর তাদের সহযোগিতা করছে প্রকাশ্যে থাকা রোহিঙ্গাদের একটা চক্র। এছাড়াও এসব ডাকাতদলের মাধ্যমে কোনও কোনও পাহাড়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে অপহৃতদের গুলি করে হত্যার নজিরও রয়েছে। জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় লোকজন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড় ঘিরে ৪-৫টি সংঘবদ্ধ ডাকাত বাহিনী সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে ডাকাত জকির আহমদ ওরফে জকির ও আবদুল হাকিম বাহিনীর দাপটে কাঁপছে রোহিঙ্গা শিবির ও সংলগ্ন এলাকার লাখো মানুষ এমন তথ্য দিয়েছেন রোহিঙ্গারা। তবে কেউ প্রকাশ্যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না।

এদিকে, স্থানীয় আক্তার উল্লাহ (২৪) নামে এক কৃষককে সম্প্রতি অপহরণের পর গুলি করে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা ডাকাতরা এমন অভিযোগ করেছে তার পরিবার। একই এলাকার শাহ মোহাম্মদ শাহেদ (২৫), মোহাম্মদ ইদ্রিস (২৭) নামে আরও দুই কৃষককে তুলে নিয়ে গেছে তারা। কৃষক আক্তার উল্লাহ স্থানীয় মিনাবাজার এলাকার মৌলভী আবুল কাছিমের ছেলে।

তার পরিবারের দাবি, সম্প্রতি আক্তার উল্লাহকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করে রোহিঙ্গা ডাকাতরা। এরপর মুক্তিপণের টাকা চেয়ে না পাওয়ায় গত শুক্রবার ভোরে আক্তার উল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর, তার লাশ টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের উনছিপ্রাং পুটিবনিয়া নামক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পশ্চিমে রাখা হয়েছে পরিবারের কাছে এমন খবরও পৌঁছে দিয়েছে ডাকাতরা। দাবি করা টাকা না দেওয়ায় অপহৃত বাকি দুইজনকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর ফলে তাদের পরিবারসহ স্থানীয়রা ভীষণ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।

এদিকে ডাকাতদলের দ্বারা অপহরণের ঘটনার খবর স্থোনীয় পুলিশ অবগত। তাদের উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। রবিবার (৩ মে) দিনভর এ অভিযান চলে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘অপহৃতদের উদ্ধারে পুলিশের অভিযান চলছে। ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চলে কোনও অপরাধীর ঠাঁই হবে না। বিশেষ করে পাহাড়ি ডাকাতদের ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।’

জানা গেছে, ২ মার্চ সকালে টেকনাফের জাদিমোরা ও শালবনের মাঝামাঝি এডরা নামক পাহাড়ে র‌্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে ৭ ডাকাত নিহত হয়েছে। তারা সবাই জকির ডাকাতের দলের সদস্য ছিল। এছাড়া ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় সেসময় সাঁড়াশি অভিযানে মারা যায় আরও কিছু ‘রোহিঙ্গা ডাকাত’। এতে ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ি ডাকাতরা কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে দল গোছাতে নতুন করে সদস্য সংগ্রহ শুরু করতে ক্যাম্পের উঠতি বয়সের যুবকদের টার্গেট করে তারা। ইতোমধ্যে তাদের দলে উঠতি বয়সী অর্ধ শতাধিক যুবক যোগ দেওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। তবে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের সদস্যরা জানান, তারাও এমন তথ্য শুনেছেন। তবে এর প্রমাণ এখনও পাননি।

এদিকে, একাধিক রোহিঙ্গা নেতা জানিয়েছেন, ‘করোনাভাইরাসে যখন সারাদেশ লকডাউনে সেসময়ে ক্যাম্পগুলোতে বেড়ে গেছে ডাকাত বাহিনীর আনাগোনা। ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ি ডাকাতদের অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে ক্যাম্পে আগের তুলনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের নজরদারি কমেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গভীর রাতে অস্ত্র-শস্ত্রসহ ক্যাম্পে চলাচল করছে তারা। তাদের ভয়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গা পরিবার ছেড়ে অন্য ক্যাম্পে চলে যেতে আশ্রয়স্থল খুঁজছে। গুটিকয় খারাপ মানুষের জন্য ১২ লাখ মানুষকে দুর্নাম বহন করতে হচ্ছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ওপর নজর রাখেন এমন কয়েকজন দায়িত্বশীল পদস্থ কর্মকর্তা জানান, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পগুলোতে ডাকাতদের আনাগোনার খবর তাদের কাছেও রয়েছে। তবে লকডাউনের কারণে আগের মতো আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষে অভিযান পরিচালনা সম্ভবও হচ্ছে না। ক্যাম্পের কিছু লোকজন তাদের দলে ভিড়ছে কিনা সেই বিষয়টি নিশ্চিত না। কিন্তু বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার ২০ বছরের পাহাড়ি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এইভাবে পাহাড়ি ডাকাতদের নির্মূল করা সম্ভব না। তাদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে হলে সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। কেননা এই অঞ্চলে পাহাড়গুলো উচুঁ-নিচু সেখানে দ্রুত গতিতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীদের অভিযান পরিচালনা করা খুবই কঠিন। তাছাড়া পাহাড়ের আশপাশে তাদের ব্যাপক সোর্স রয়েছে। তাই অভিযান পরিচালনা করার আগেই তাদের কাছে খবর পৌঁছে যায়। ফলে দ্রুত তারা অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে।

স্থানীয় সুত্রে বলছে, বেশির ভাগই ডাকাত জকির ও হাকিম বাহিনীর সদস্য। টেকনাফের নাইট্যং পাহাড়, হোয়াইক্যং, উনচিপ্রাং, মিনাবাজার, পুটিবনিয়া, লেদা, জাদিমুরা ও শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়গুলোতে তাদের আনাগোনা রয়েছে।

এই অঞ্চলে থেকে ডাকাত মুক্ত করতে পাহাড়ে ‘ওয়াচ টাওয়ার’ নির্মাণ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি এসব ডাকাতের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে ড্রোন বা স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি অভিযান চালানোর পাহাড়ের আশেপাশের বাড়িঘরে থাকা মানুষদের নিশ্চল করে বা পুরোপুরি ঘরবন্দি করে এবং মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে ডাকাতদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিননীর প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন তারা। রোহিঙ্গা ডাকাত নির্মূল অভিযানে আরেকটা সমস্যা হচ্ছে ভাষাগত সংকট। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক হওয়ায় তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। আবার তারা স্থানীয়দের এমনকি বাংলা ভাষাও বোঝে। ফলে ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের ও পাহাড়ের আশেপাশে থাকা স্থানীয়দের মধ্যে যারা প্রাণ ভয়ে ডাকাতদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে বাধ্য হন তাদের কাছ থেকে ডাকাতরা সহজেই তথ্য পেয়ে অভিযানের সময় দূরে সরে যায়। তাই ভাষাগত সংকট দূর করতে এসব ডাকাত দলের মাধ্যমে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমন রোহিঙ্গা বা স্থানীয়দের অভিযানের সময় সঙ্গে রেখে প্রতিপক্ষের ভাষা, ইঙ্গিত বা আচরণ বোঝার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

হাকিম ও জকিরের উত্থান

মিয়ানমারের রাশিদং থানার বড়ছড়া গ্রামের জানি আলীর ছেলে আবদুল হাকিম। ২০১৫ সালে ১৩ জুন টেকনাফ পৌরসভার পুরাতন পল্লানপাড়ার বাসিন্দা ও পুলিশের তথ্যদাতা (সোর্স) মোহাম্মদ সেলিম ও ওরফে মুন্ডি সেলিমকে কুপিয়ে হত্যার পর প্রথম আলোচনায় আসে এই ডাকাত সর্দার। এরপর ২০১৬ সালে ৪ জুলাই টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি সিরাজুল ইসলামকে (৬৫) গুলি করে হত্যার ঘটনায় হাকিমের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা হাকিম ডাকাত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে টেকনাফের ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ে ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন আবদুল হাকিম।

অন্যদিকে, টেকনাফের নয়াপাড়ার সি ব্লকের আমিনের ছেলে জকির আহমদ ওরফে জকির ডাকাত (২৮) এর নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। তাদের হাতে দেশি অস্ত্র ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। একসময় রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করতো নূরে আলম ডাকাত। ২০১৬ সালে ১৪ মে তার গ্রুপ এক আনসার সদস্যকে হত্যা করে তার অস্ত্র লুট করেছিল। ২০১৮ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় ডাকাত জকির। এরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নেয় সলিম বাহিনী। নূরে আলম ও সলিম দুজনের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল জকিরের। কিন্তু, ইয়াবার মুনাফার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সলিমকে হত্যা করে জকির বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে ক্যাম্পে জকির একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকে জাদিমুরা ও শালবন ক্যাম্পের পাহাড়ে অপরাধের ‘রাজা’ বনে যান।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্রে আরও জানা গেছে, চলতি বছরের পাচঁ মাসের (পহেলা মে পর্যন্ত) বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩৩ জন নিহত হয়েছে। তার মধ্যে ১৯ জন সক্রিয় ডাকাত ছিল। এর মধ্যে গত ২ মার্চ র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৭ জন, ১২ মার্চ ২ জন এবং সর্বশেষ পহেলা মে ২ জনসহ মোট ১১ জন পাহাড়ি ডাকাত নিহত হয়েছে। তারা সবাই জকির বাহিনীর সদস্য ছিল। সদস্য কমে যাওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন করে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেছিল ডাকাত বাহিনীরা।
এ বিষয়ে র‌্যাব-১৫ সিপিসি-১, টেকনাফ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার অ্যাডিশনাল এসপি বিমান চন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড় ঘিরে ডাকাত গ্রুপসহ অন্যান্য যেসব অপরাধ চক্র সক্রিয় রয়েছে, তাদের গ্রেফতারের অভিযান চলছে। যে কোনওভাবে ডাকাতদের নির্মূল করা হবে।’

আরও খবর