কক্সবাজারে নির্জন সৈকতে জাল ছড়াচ্ছে সাগরলতা, গড়ছে বালিয়াড়ি!

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার ◑

কক্সবাজারের পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ ১৮ মার্চ থেকে। সৈকত হয়ে পড়েছে জনমানব শূণ্য। কিন্তু এ সমুদ্র সৈকতের স্বতন্ত্র বাস্তুরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সাগরলতা এ নজিরবিহীন নির্জনতার সুযোগে নগ্ন সৈকতে ছড়িয়ে দিচ্ছে সবুজের জাল, আর এ জালে রাশি রাশি বালুরাশি আটকে সৃষ্টি হচ্ছে বালিয়াড়ি।

সমুদ্র সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বড় বড় বালির পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরির মূল কারিগর হিসাবে পরিচিত সাগরলতা। সাগরে ঝড়-তুফান বা ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস উপকূলে ঠেকিয়ে রাখে বলে বালিয়াড়িকে সৈকতের রক্ষাকবচ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পর্যটন শিল্পের কারণে দখল ও দূষণের শিকার হয়ে গত প্রায় ৩ দশকে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের বড় বড় বালিয়াড়িগুলো প্রায়ই হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সমুদ্র তীর ভাঙনের শিকার হয়ে হাজার হাজার একর ভূমি সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আর সেই বিধ্বস্ত প্রকৃতি আপনাআপনি পূনর্গঠিত হচ্ছে করোনা নিষেধাজ্ঞার নির্জনতার সুযোগে।

মাত্র এক দশক আগেও কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতজুড়ে গোলাপী-অতিবেগুণী রঙের ফুলেভরা সৈকতে এক অন্য রকমের সৌন্দর্যময় পরিবেশ ছিল। সেই পরিবেশের কথা ভেবে শহরের অনেক বাসিন্দা ও পর্যটক এখন কেবলই আক্ষেপ করেন। কিন্তু সেই সুযোগটিই এখন এনে দিয়েছে করোনা সতর্কতা।

গত কয়েকদিন সরেজমিন কক্সবাজারের নির্জন সৈকতের বিভিন্ন স্পটে গিয়ে চোখে পড়ে আপন গতিতে প্রকৃতির পরিবেশগত পুনরুদ্ধারের বিষয়টি।

সৈকতের পরিবেশগত পূনরুদ্ধারে সাগরলতার মতো দ্রাক্ষালতার বনায়নের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডা এবং অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সৈকতের হ্যাস্টিং পয়েন্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন সৈকতে বালিয়াড়ি সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের দেখানো পথে সৈকতের মাটির ক্ষয়রোধ ও সংকটাপন্ন পরিবেশ পুনরুদ্ধারে বিশ্বের দেশে দেশে কাজে লাগানো হচ্ছে সাগরলতাকে। উন্নত বিশ্বের গবেষণালব্দ ফলাফলে সাগরলতার মত দ্রাক্ষালতা সৈকত অঞ্চলে পরিবেশগত পূনরুদ্ধার ও মাটির ক্ষয় রোধের জন্য একটি ভাল প্রজাতি বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাগরলতা ন্যূনতম পুষ্টিসমৃদ্ধ বেলে মাটিতে বেড়ে ওঠতে পারে। তার পানির প্রয়োজনীয়তাও কম হয়। উচ্চ লবণাক্ত মাটিও তার জন্য সহনশীল। এর শিকড় মাটির ৩ ফুটের বেশি গভীরে যেতে পারে। এটি দ্রæতবর্ধনশীল একটি উদ্ভিদ। বাইরের কোন হস্তক্ষেপ না হলে লতাটি চারিদিকে বাড়তে থাকে এবং সর্বোচ্চ সামুদ্রিক জোয়ারের উপরের স্তরের বালিয়াড়িতে জাল বিস্তার করে মাটিকে আটকে রাখে। এরপর বায়ূ প্রবাহের সাথে আসা বালি ধীরে ধীরে সেখানে জমা হয়ে মাটির উচ্চতা বৃদ্ধি করে। এতে সাগরলতার ও সৈকতের মাটির স্থিতিশীলতা তৈরি হয়।

সাগরলতার ইংরেজি নাম রেলরোড ভাইন, যার বাংলা শব্দার্থ করলে দাঁড়ায় রেলপথ লতা। আসলেই রেলপথের মতোই যেন এর দৈর্ঘ। একটি সাগরলতা ১শ’ ফুটেরও বেশি লম্বা হতে পারে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ওঢ়ড়সড়বধ ঢ়বং পধঢ়ৎধব.
সাগরলতা নিয়ে কক্সবাজারের দরিয়ানগরে সীমিত আকারে পরীক্ষামূলক গবেষণা করেন বাংলাদেশ সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক।

তিনি বলেন, সৈকতের পরিবেশ পূনরুদ্ধারে আমরা সাগরলতার বনায়ন ও তা সংরক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। যা প্রকৃতি এখন আপন মনে গড়ে নিচ্ছে। তিনি এর সত্যতা যাচাই করার জন্য সংশ্লিষ্টদেরকে শহরের কলাতলী ও দরিয়ানগর সৈকত পরিদর্শনের আহবান জানিয়ে বলেন, করোনা নিষেধাজ্ঞার সুযোগকে পরিবেশগত পূনর্গঠনে কাজে লাগাতে হবে। সাগরলতা ও বালিয়াড়ি সংরক্ষণ করতে হবে।

কক্সবাজারের বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম বলেন, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রের তীর ধরে ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু পাহাড়ের মতোই বড় বড় বালির ঢিবি ছিল। এসব বালিয়াড়ির প্রধান উদ্ভিদ ছিল সাগরলতা। সাগরলতার গোলাপী-অতিবেগুণী রঙের ফুলে সৈকতে এক অন্য রকমের সৌন্দর্য তৈরি হত। কিন্তু সাগর লতা ও বালিয়াড়ি হারিয়ে যাওয়ায় গত প্রায় ৩ দশকে কক্সবাজার সৈকতের ৫শ মিটারের বেশি ভ‚মি সাগরে বিলীন হয়ে গেছে।

বালিয়াড়িকে সৈকতের রক্ষাকবচ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বালিয়াড়ির কারণে সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াস লোকালয়ে তেমন ক্ষতি করতে পারে না।

৯১ সালের ঘুর্ণিঝড়ের সময়েও বালিয়াড়ির পাশে থাকা বাড়িঘরগুলো ছিল নিরাপদ। সেখানে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি যেমন ওঠেনি, তেমনি বাতাসের তোড়ও ছিল অনেক কম। ফলে বাড়ীঘরগুলো ছিল নিরাপদ। অথচ যেখানে বালিয়াড়ি ছিল না সেখানেই জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বাড়ীঘর তলিয়ে দেয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বনবিদ্যা ইন্সটিটিউটের প্রফেসর ড. কামাল হোসেন জানান, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতে গত প্রায় ২ দশক আগেও বড় বড় বালির পাহাড় বা বালিয়াড়ি দেখা যেত। আর এসব বালিয়াড়িকে ঘিরে সাগরলতাসহ নানা লতা-গুল্ম ও উদ্ভিদরাজি গড়ে ওঠত এবং এসব উদ্ভিদরাজিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠত স্বতন্ত্র প্রাণবৈচিত্র্যও। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং দখল দূষণের কারণে সমুদ্র তীরের বালিয়াড়িগুলো এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে সাগরলতাও এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
বালিয়াড়িকে কক্সবাজার অঞ্চলে ডেইল নামে অভিহিত করা হয়।

কক্সবাজার উপকূলের কুতুবদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত এই ধরনের বহু বালিয়াড়ি দেখা যেত। সমুদ্র তীরের বাসিন্দারা এই ধরনের বালিয়াড়ি ঘিরেই লোকালয় তৈরি করে। আর এ লোকালয়গুলো ‘ডেইলপাড়া’ নামে পরিচিতি পায়।

যেমন কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল, কক্সবাজার শহরের ফদনার ডেইল, উখিয়া জালিয়াপালং এর ডেইল পাড়া, টেকনাফের মুন্ডার ডেইল ও সেন্টমার্টিনের ডেইলপাড়া অন্যতম।

কক্সবাজার জেলায় এই ধরনের আরো বহু ডেইলকেন্দ্রিক লোকালয় রয়েছে। একসময় কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে কলাতলী পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ও অন্তত ৫শ ফুট চওড়া একটি ডেইল ছিল। এই ডেইলের কোন কোন স্থানে উচ্চতা ৩০ ফুটেরও বেশি ছিল। যেখানে থরে থরে ফোটা সাগরলতার ফুল দেখা যেত। আর তা দেখে চোখ জুড়াত পর্যটকদের। কিন্তু এসব বালিয়াড়িকে ঘিরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সরকারী বেসরকারী নানা স্থাপনা। ফলে এখন আর শহরের কোথাও তেমন একটা সাগরলতা দেখা যায় না। তবে শহরের বাইরে যেখানে কিছু বালিয়াড়ি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, সেখানে সদম্ভে টিকে থেকে সৌন্দর্য্যের দ্যুতি ছড়াচ্ছে সাগরলতা।

সাগরলতা সৈকতের অন্যান্য প্রাণী; যেমন বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া ও পাখির টিকে থাকার জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। সাগরলতার সবুজ পাতা মাটিকে সূর্যের কিরণ থেকে এমনভাবে রক্ষা করে, যাতে সূর্যের তাপ মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি বাস্পীভ‚ত করতে না পারে। এতে মাটির নীচের স্তরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য প্রাণীক‚লের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। তাই বালিয়াড়ি ও সাগরলতা না থাকলে আরো বহু প্রাণী পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন ঢাকার ইন্ডিপেন্ডেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী রাগিবউদ্দিন আহমদ।

তিনি বলেন, কক্সবাজার সৈকতের সৌন্দর্যমানকে সুসজ্জিত করতে হলেও সাগরলতার দরকার। সমুদ্র সৈকত না থাকলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পও টিকতে পারবে না। তাই পর্যটনের স্বার্থেও বালিয়াড়ি ও বালিয়াড়ি উদ্ভিদ রক্ষার মাধ্যমে কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দরকার।

এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট ভ‚-তত্ত¡বিদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী ছিদ্দিকী বলেন, ভ‚-পৃষ্ঠের পাহাড় বা নদীতীরবর্তী বেড রক (খারাপ পাথর) থেকে কোয়ার্টজ কণাগুলি ক্ষয়ে গিয়ে এবং সাগরে অবস্থিত বিভিন্ন ঝিনুক-শামুক জাতীয় প্রাণীর শরীরের ভেঙ্গে যাওয়া কনা থেকে বালু তৈরি হয়।

পাহাড়ী ঢলের সাথে আসা ভ‚-পৃষ্ঠের বালি সমুদ্র মোহনায় জমা হয়ে এবং সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে প্রাণীকনা সৈকতে জমা হয়ে তীর গঠন করে। আর সেই তীরের স্থিতিশীলতার জন্য যে উদ্ভিদটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে, সেটি হল সাগরলতা।

আরও খবর