অনলাইন ডেস্ক ◑ ‘মুজিববর্ষের’ মধ্যে দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না- এমন দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই মুজিববর্ষের ভেতরই বাংলাদেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও জাতির পিতার আদর্শের সৈনিকদের প্রতি অনুরোধ করবো, এই কথাটা দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। খুঁজে দেখুন, কারা গৃহহীন রয়েছেন, কাদের থাকার জায়গা নেই। চেষ্টা করুন ঘর করে দিতে। না পারলে সরকার টাকা দেবে ঘর করার জন্য। সবাইকে ঘর করে দেওয়া হবে। মুজিববর্ষে দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে- এটা হতে পারে না।
শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। এর আগে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন সারাদেশে জাতির পিতার অবিস্মরণীয় ভাষণের স্মারক ঐতিহাসিক ৭ মার্চ পালন করেছে।
পঁচাত্তর পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানানোর অপচেষ্টার প্রসঙ্গ তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, এদেশে এমন একটা সময় ছিল যখন মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান সেটাও মুছে ফেলা হয়েছিল। এমনভাবে বিকৃত ইতিহাস তৈরি করা হলো, যেন কোনো এক মেজর বাঁশিতে ফুঁ দিলেন, ওমনি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, আর দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো! অথচ তিনি নিজেই চাকরি করতেন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে, ৪০০ টাকা বেতন পেতেন। তাকেই ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু কোনো মেজরের বাঁশির ফুঁতে দেশ স্বাধীন হয়নি- সেই সত্যই আজ উদ্ভাসিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ১৭ মার্চ থেকে আগামী বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত দেশজুড়ে সাড়ম্বরে ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপনের প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মুজিববর্ষ উদযাপনে অনেক কর্মসূচির চিন্তা করছি। এই মুজিববর্ষে দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে- এটা হতে পারে না। আমরা চাই, একটি মানুষও যেন গৃহহারা না থাকে। যাদের ঘর নেই তাদের আমরা ঘর করে দেব।
তিনি বলেন, মুজিববর্ষ উদযাপনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এতে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে। তবে সবাইকে একটা কাজ করতে হবে। জাতির পিতা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ যেন অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান পায়। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সচেষ্ট ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি সংবিধানে মৌলিক চাহিদা পূরণের কথা উল্লেখ করে গেছেন। তার স্বপ্ন ছিল একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। এজন্য তিনি গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কাজেই এই মুজিববর্ষের মধ্যে এমনভাবে কাজ করতে হবে- যেন দেশের একটি মানুষও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিজ নিজ এলাকায় গৃহহীন মানুষের বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতার আদর্শের সৈনিক হিসেবে প্রতিটি নেতাকর্মীর একটি দায়িত্ব রয়েছে, দেশাত্মবোধ রয়েছে। মুজিবর্ষে খুঁজে দেখুন, কারা এখনও গৃহহীন রয়েছেন। তাদের একটা করে ঘর করে দেবেন। আপনাদের টাকা না থাকলে, ঘর করে দিতে না পারলে- টাকা আমি দেবো। বাংলার মাটিতে একটি মানুষও আর ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না।’
বক্তব্যের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এর তাৎপর্য তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেকে অনেক কথাই বলেছেন, অনেক কথাই উচ্চারণ করেছেন। আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব না। আমি শুধু বলব, ৭ মার্চের ভাষণের একেকটি লাইনই একেকটি কোটেশন। আর সেই লাইনগুলো ছিল সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য। সময়ের প্রয়োজনে জাতির সামনে যা কিছু বলার প্রয়োজন ছিল, বঙ্গবন্ধু সেদিন তা বলে গেছেন তার ভাষণে।’
তিনি বলেন, ৭ মার্চের ভাষণের পটভূমি হয়তো অনেকে জানেন। ওই সময় অনেকে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। অনেক জ্ঞানী-গুণীজন লিখিত আকারে ভাষণ তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমাদের ছাত্রনেতারা, তাদের অনেকেই পরে আর আমাদের সঙ্গে থাকেননি- তারাও বলেছিলেন, ‘এখনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে, নইলে জাতি হতাশ হবে’। কিন্তু জাতির পিতা জানতেন, কখন কোন পদক্ষেপটি নিতে হবে। সেদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি ছিল প্রকারান্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য মানুষের তৈরি হওয়ারই নির্দেশনা।
কেন এমন কৌশলী ঘোষণা দিতে হলো বঙ্গবন্ধুকে- সে প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তখনকার যে অবস্থা, অনেক খবরই আমরা জাতির পিতার পরিবারের সদস্য হিসেবে পেতাম। যা বাইরের মানুষের জানার কথা নয়। ওই সময় পাকিস্তানিরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। তাদের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার রেডি ছিল। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কী বলবেন- সে অনুযায়ী পাকিস্তানিদের ‘অ্যাকশন প্ল্যানও’ রেডি ছিল। ব্রিটিশ আমলে যেমন জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক ওই রকম প্রস্তুতিও পাকিস্তানিদের ছিল। তাই জাতির পিতাকে কৌশলী হতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবেরও বড় ভূমিকা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভাষণ দেওয়ার আগে অনেকেই অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। ভাষণ দিতে যাওয়ার আগে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন আমার মা (বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব)। যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে আমার মা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। আমার মা বলেছিলেন, তুমি সারাজীবন মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছো। অনেকে অনেক কথা বলবে, কিন্তুতুমিই সবচেয়ে ভালো জানো, কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সেকথাই বলবে। ৭ মার্চের ভাষণটা দেখলে বুঝবেন বঙ্গবন্ধু কিন্তু তার মনের কথাই বলেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সবাইকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। দেশে একটি গেরিলা যুদ্ধ হবে, সেখানে কার কী দায়িত্ব সে কথাও তিনি বলে দিয়েছিলেন। তার ভবিষ্যৎবাণী করার অদ্ভুত শক্তি ছিল। সত্তরের নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, আমরা নির্বাচনে জয়লাভ করবো। কিন্তু তারা ক্ষমতা দেবে না। পরে আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করবো। ৭ মার্চের ভাষণে সেই যুদ্ধের জন্য তিনি সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন। বক্তৃতা শেষে তিনি একথাও বলেছিলেন তার ওপর আস্থা আছে কি-না। জনগণও জানিয়েছিল আস্থা আছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু মানুষের কাছ থেকে ওয়াদা নিয়ে রেখেছিলেন, তারা তার মানবেন কি-না। মানুষ তাদের কথা রেখেছিল। তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন জনগণ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।
তিনি বলেন, একটি জাতি- তার সামনে কোনো আশা নেই, ভরসা নেই, স্বপ্ন নেই। একটি মাত্র ভাষণের মাধ্যমে সেই জাতিকে বঙ্গবন্ধু আশার বাণী শুনিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এই ভাষণে একদিকে তিনি জাতিকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলেছেন, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও বলেছেন। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। একটা দেশকে স্বাধীন করা ও একটি জাতি সৃষ্টি করা- পৃথিবীর খুব কম রাজনৈতিক নেতাই তা করতে পেরেছেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ সারাবিশ্বের একমাত্র ভাষণ, যা হিসেব করে পাওয়া যাবে না কতজন কত ঘণ্টা এই ভাষণ শুনেছেন। কতজন কত সময় ধরে এই ভাষণ বাজিয়েছেন। সারা পৃথিবীতে এটিই একটি ভাষণ যা ৪৯ বছর ধরে এভাবে তার আবেদন ধরে রাখতে পেরেছে।
পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসন আমলে ৭ মার্চের ভাষণ ও বঙ্গবন্ধুর নিষিদ্ধ করে রাখার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জিয়া-এরশাদ-খালেদা সবাই ৭ মার্চের ভাষণ বাজানোর জন্য বাধা দিয়েছেন। তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন বারবার ইতিহাস বিকৃতি করেছেন। আমার ভাবলে দুঃখ হয় যে, ৭ মার্চের ভাষণ ও জাতির পিতার নাম দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের দেশে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। যদিও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে এই ভাষণ বাজিয়েছেন। ৭ মার্চের সেই ভাষণই আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আমি জানি না যারা এই ভাষণ ও বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন- তারা এখন লজ্জা পান কি-না। অবশ্য তাদের লাজলজ্জা আছে বলে মনে হয় না। আর নির্লজ্জ না হলে তো তারা এটা মুছে ফেলতে চাইতেন না।
গত ১১ বছরে দেশ ও জাতির উন্নয়নে তার সরকারের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সৌভাগ্য ১৯৯৬ সালে যখন স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পালিত হয়েছিল, তখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। আর এখনও আমরা সুযোগ পেয়েছি, ক্ষমতায় থেকে জাতির পিতার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ পালন করার। সেই সঙ্গে ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও আমরা পালন করবো। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় সূচনা বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আরও বক্তব্য দেন- দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য পারভীন জামান কল্পনা, ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি, দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী প্রমুখ। কবিতা আবৃত্তি করেন শিমুল মোস্তফা। পরিচালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-