বিশেষ প্রতিবেদক ◑
কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির বিশেষ সভায় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমি অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখি না। এরইমধ্যে যেভাবে ক্রাইমে জড়িয়ে যাচ্ছে। এটি কন্ট্রোল করা না গেলে অবস্থা ভয়াবহ হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে।
রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারী) সকালে কক্সবাজার জেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির বিশেষ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা মনে করে সন্তান জন্ম নেওয়া ফরজ। তাই সেখানে জন্মহার বেশি। আমার মনে হচ্ছে অতি সন্নিকটে রোহিঙ্গারা ২৫ লাখে পরিণত হবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির বিশেষ সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম এমপি, আশেক উল্লাহ রফিক এমপি এবং সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান সহ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রতিনিধি, বিজিবি, র?্যাব, কোস্ট গার্ডের অধিনায়কবৃন্দ, কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর স্থানীয় প্রধান সহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ বিশেষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সভায় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল করিম বলেন, পর্যটন শহর হিসেবে আইনশৃঙ্খলা মোটামুটি ভাল আছে। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আছে। ক্যাম্পে আছে, ক্যাম্পের বাইরেও আছে। রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা অনেক উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যেগুলো আমাদেরকে অবাক করে দেয়। সন্ত্রাসীদের তৎপরতা, মৌলবাদীদের আনাগোনা, নানা অচেনা মানুষের যাওয়া আসা নানাভাবে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরও আমরা আশঙ্কামুক্ত নয়। কক্সবাজার একটি সম্ভাবনাময়ী স্থান। আন্তর্জাতিক চক্রান্তে কক্সবাজারকে যদি ধ্বংস করে দিতে পারে, তাহলে আমাদের দেশের সার্বিক ক্ষতি হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় আছে। সেই কার্যালয় নিজেদের মতো করে কাজ করে। তারা যদি জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে নিয়মিত আলোচনা না হয় তাহলে যেকোন একটি ছিদ্র দিয়ে এমন কোন বিষয় বের হয়ে যাবে যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এজন্য আজকের সভা থেকে অনুরোধ থাকবে শরণার্থী ত্রাণ ও পুর্নবাসন কমিশনও যেন জবাবদিহিতার আওতায় আসে। অন্যান্য অফিসগুলোতে কি হয় না হয় সবকিছু জানানো হয়। কিন্তু আরআরআরসি অফিস জানায় না। তাদেরকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
জেলা মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার মো. শাহজাহান বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে অস্ত্রের মহড়া চলছে। অস্ত্রের মহড়ায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা হচ্ছেন ক্যাম্পের চেয়ারম্যান। রোহিঙ্গারা ভোটের মাধ্যমে এই চেয়ারম্যানদের নির্বাচিত করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আবার কিসের নির্বাচন, কিসের চেয়ারম্যান সেটা আমার বুঝে আসে না। সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করে চেয়ারম্যানরা, চেয়ারম্যানদের নিয়ন্ত্রণ করে ক্যাম্প ইনচার্জরা আর ক্যাম্প ইনচার্জদের নিয়ন্ত্রণ করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন।
অর্থ্যাৎ মনে হচ্ছে যে, আরআরআরসি’র কোন জবাবদিহিতা নেই। এনজিওদের সাথে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের মধুচন্দ্রিমা চলে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় কাটা হয়েছে, পর্যটনের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো এনজিও রোহিঙ্গাদের স্থায়ী নিবাসের জন্য ব্যবস্থা করছে। রোহিঙ্গাদেরতো চলে যেতে হবে, তাদের কিসের স্থায়ী নিবাস? এটাতে আমার দক্ষিণ সুদানের কথা মনে হচ্ছে। আমার ভয় লাগছে যে এসব অশুভ তৎপরতা একদিন কক্সবাজারকে তথা বাংলাদেশকে দক্ষিণ সুদানে পরিণত করবে।
জেলা জাসদের সভাপতি নইমুল হক চৌধুরী টুটুল বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে মাদক, অস্ত্রের মহড়া চলছে। এদেশের বিরোধী কাজ করছে। অনেক এনজিও’র অশুভ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। গেল বছর একটি এনজিও রোহিঙ্গাদের বিপুল পরিমাণ নিড়ানী দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা সফল হলে কক্সবাজারের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী আক্ষেপ নিয়ে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে আমার বাড়ি। আমার একটাই দাবী, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে মনে হচ্ছে ভাসানচরে যে পুর্নবাসনের জন্য আবাসনগুলো গড়ে তোলা হয়েছে সেগুলোতে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হোক। রোহিঙ্গাদেরকে উখিয়া দিয়ে দেওয়া হোক। দিনদিন তারা যেভাবে সংগঠিত হচ্ছে, ক্যাম্প ম্যানেজম্যান্ট, এনজিও এবং রোহিঙ্গা এটা থেকে কিভাবে উত্তোরণ হবে আমি জানি না। এখান থেকে উত্তোরণের জন্য একটি করণীয় নির্ধারণ করার জন্য। আমরাও এদেশের মানুষ। আমাদেরকে এই আপদ থেকে রক্ষা করুন।
জেলা আওয়ামী লীগের অ্যাড. সিরাজুল মোস্তফা বলেন, এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে নেই। কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের ফেরত না পাঠানোর মিশনে নেমেছেন। এই অশুভ তৎপরতা ঠেকাতেই হবে। দলের প্রতিনিধিত্ব করার কারণে উর্ধ্বতন মহল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে চায়। কিন্তু আমরা কিছুই জানাতে পারি না। কারণ আরআরআরসি আমাদের সাথে কোন বিষয়ে সমন্বয় করেন না।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আমাদের এখানে বর্তমানে ৫১ জন এডমিনের কর্মকর্তা দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমাদেরকে জবাবদিহিতা করতে হয়। তবে সেটা ম্যাকানিজম ভিন্ন। আমরা জবাবদিহির বাইরে নয়, আমরা করোব তবে জবাবদিহির ম্যাকানিজমটা কি হবে সেটা বের করা দরকার। এনজিওদের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে এনজিও অ্যাপায়ার্স ব্যুরো। এনজিওদের জবাবদিহির আওতায় আনার মতো কোন ফোরাম নেই। আমরা দেখি যাতে ওভারলেপিং, ডুপ্লিকেশন না হয়।
তিনি আরও বলেন, অস্ত্রের মহড়া বা অন্যান্য অপরাধ কর্মকান্ডের বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বীগ্ন। বিশেষ করে ১৫ বছর বা তার কাছাকাছি বয়সের যে বাচ্চাগুলো আছে তাদেরকে নিয়ে আমাদের বড় চ্যালেঞ্চ। কারণ তারা নিজেরা দেখেছে, তার মাকে হত্যা করেছে, বোনকে ধর্ষণ করেছে, বাপকে হত্যা করেছে। এরা এই ধরণের সাইকোলোজি নিয়ে এখানে এসেছে। ওদের কাছ থেকে আমরা ভাল কিছু আশা করতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, সবার সমন্বয়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ৭টি পুলিশ ক্যাম্প ক্যাম্পের ভেতরে করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ক্যাম্পে নিয়োজিত রয়েছে। ৬টি গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করে। ঢাকার এসবি এবং পুলিশ সুপারের এসবিও কাজ করে। সর্বোপরি চেষ্টা করছি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে। ৯২ সালে যখন রোহিঙ্গা আসে তখন ক্যাম্পের ভেতরে যাওয়া যায়নি, গুলি করতে হয়েছে। কিন্তু এবার সেই ধরণের কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। আমি মনে করি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আছে। যেসব এনজিওদের ব্যাপারে অভিযোগ আছে সেগুলোকে ক্যাম্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ডিজিএফআই’র কর্ণেল জিএস আবুজার আল জাহিদ বলেন, পুরাতন দুটি রোহিঙ্গা শিবিরে চেয়ারম্যান পদ্ধতি আছে। নতুন ৩২ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে মাঝি নিয়োগ দেওয়া হয়। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো চেয়েছিল চেয়ারম্যান বানানোর জন্য। কিন্তু সরকার মেনে নেয়নি।
তিনি বলেন, বর্তমানে ১২৭৩ জন রোহিঙ্গা কারাগারে আছে। একারণে কক্সবাজার কারাগারে ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এরফলে এখান থেকে বান্দরবানেও নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু তারপরও ধারণ ক্ষমতার অনেকগুণ বেশি। কারাগারে তাদের জন্য পৃথক স্থান করা দরকার। তাদের যে মামলাগুলো আছে সেগুলো পরিচালনার জন্য পৃথক ট্রাইবুন্যাল করার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা। তবে বেকার থাকার কারণে তাদের কেউ কেউ অপরাধে জড়াচ্ছে। জঙ্গিবাদসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৬৪ জন সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি মারা গেছেন।
তিনি আরও বলেন, সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে তাদেরকে দ্রুত প্রত্যাবাসন করাই একমাত্র সমাধান। কারণ রোহিঙ্গারা দূর্বল পজিশনে আছে। যেকোন স্বার্থান্বেষী মহল তাদেরকে জঙ্গিবাদে টেনে নিয়ে যেতে পারে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত করতে পারে। এই ঝুঁকিটা সব সময় আছে।
সাংসদ জাফর আলম বলেন, রোহিঙ্গারা এখন আমাদের গলার কাটা। ৭০ শতাংশ এনজিও চায়না রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যাক। তারা মনে করে, রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এই সমস্যার সমাধান দরকার।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-