বিশেষ প্রতিবেদক ◑
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভুমি অধিগ্রহণ অফিসে (এলএও) স্থানীয় দালাল চক্রের চেয়ে বেশী দালাল রয়েছে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বহিরাগত দালালরা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করা হয় প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের রেফারেন্স দিয়ে। সেই সাথে এলএ অফিসে কর্মরত সার্ভেয়ার সহ অন্যান্যদের আত্বীয়য়-স্বজনদেরও একটি বড় অংশ দালাল হিসাবে রয়েছেন কর্মরত।
অভিযোগ উঠেছে, ভুমি অধিগ্রহণের ক্ষতি পূরণের টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে তদবিরের কাজে স্থানীয় আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ সহ নানা পেশার লোকজনকে কৌশলে দীর্ঘদিন ধরে ধারে কাছে ভীড়তে দেয়া হয়না। কেননা এলএ অফিসের কর্মকর্তারা স্থানীয়দের তদবিরের সুযোগ দিলে কমিশনের ভাগ কম পেয়ে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির একজন প্রবীণ সদস্য বলেন-‘ এ জেলার ভুমি বিরোধ বলেন আর ভুমির প্রকৃত বলেন স্থানীয় আইনজীবীদেরই সবচেয়ে বেশী জানা থাকে। তদুপরি আইনজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে জেলাবাসীদের জায়গা-জমি নিয়ে আইন সঙ্গত সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। কিন্তু ভুমি অধিগ্রহন অফিসে আগের সেই রেওয়াজের সুযোগ এখন আর নেই।’ আইনজীবীরা বলেন, আইনজীবীদের কোন মক্কেল থেকে অসাধু ব্যক্তিরা তেমন সুযোগ নিতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত দালাল শ্রেণীর লোকজনই কমিশনের ভিত্তিতে ভুমির ক্ষতিগ্রস্থদের সর্বনাশ করে দিচ্ছেন।
সংগত কারনেই স্থানীয় লোকজন অস্থানীয়দের তুলনায় জমির ক্ষতিগ্রস্থদের ঠকানোর ব্যাপারে সজাগ থাকেন বেশী। এমনকি অতিরিক্ত কমিশন নেয়ার জন্য তাৎক্ষনিক প্রতিবাদও করেন স্থানীয়রা। তাই কমিশনের ভাগ বেশী পাওয়ার আশায় স্থানীয় কোন প্রভাব প্রতিপত্তিদের তদবিরের সুযোগ দেয়া হয় না। ইতিমধ্যে দেশব্যাপি জানাজানি হয়ে পড়েছে যে, কক্সবাজারের ভুমি অধিগ্রহণ অফিসে জমির ক্ষতিপূরণের কোটি কোটি টাকা প্রদানের বিসয়টি। তাই দেশের নানা প্রান্তের হরেক তদবিরকারকরাও এসে ভীড় জমিয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন-‘ যথাসাধ্য চেষ্টা করে আসছি স্বচ্ছতার মাধ্যমে জমির অধিগ্রহণের টাকা পরিশোধ করতে।
এজন্য আমি ক্ষতিগ্রস্থদের নিজ হাতে চেক দেয়ার সময় জানতে চাই অফিসের কাউকে অবৈধ টাকা দিতে হয়েছে কিনা। লোকজন এরকম অভিযোগ করলেই সাথে সাথে ব্যবস্থা।’
জেলা প্রশাসক বলেন, যারা এলএ অফিসে দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় এবং আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অন্যান্য জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে কক্সবাজারে। বর্তমানে ৭০ টিরও বেশী উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলছে। প্রকল্পগুলোর জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২০ হাজার একরেরও বেশী পরিমাণ জমি। কক্সবাজার জেলা শিক্ষাদীক্ষায় এমনিতেই পেছনে রয়েছে।
তদুপরি ভূ-সম্পত্তির মালিক যারা তাদের বেশীর ভাগই গ্রামের নীরিহ শেণীর লোকজন। এসব লোকজন তেমন ঝক্কি-ঝামেলার মুখোমুখি হতে চান না। এমন সুযোগটি নিয়ে থাাকেন অস্থানীয় দালালগন। দালালরাই বেশী কমিশনে দরদাম করে এলএ অফিসের সার্ভেয়ার, কানুনগো সহ অন্যান্যদের সাথে গোপন আতাঁতে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করে দিয়ে থাকেন।
অভিযোগ উঠেছে, অনেক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি পদস্থ কর্মকর্তারাও কক্সবাজার এলএ অফিসে স্বশরীরে জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা আদায়ের বিষয়ে তদবির করেন। জানা গেছে, অবসরপ্রাপ্ত উপ সচিব পরিচয় দিয়ে পর্যন্ত প্রায়শ তদবিরের কাজ করেন এক ব্যক্তি। তদুপরি তদবিরবাজদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখ হচ্ছেন হারুন প্রকাশ উত্তরবঙ্গের হারুন নামের একজন তদবিরকারি (দালাল)। কক্সবাজার শহরের পেশকার পাড়ায় বাসা নিয়ে তিনি তদবিরের কাজ করেন।
এলএ অফিসে এরকম কাজ করেন মানিক প্রকাশ ঢাকাইয়া মানিক ও বাবুল নামের অরেকজন ঢাকাবাসী পরিচয়ধারী তদবিরবাজ ব্যক্তিও। অনুরুপ কর্মরত সার্ভেয়ারগন তাদের আত্বীয়য় স্বজনদের এখানে নিয়ে এসে তদবিরের কাজে খাটিয়ে যাচ্ছেন। র্যাবের অভিযানে পলাতক ফেরদৌস খান নামের একজন সার্ভেয়ার তার আপন ফুফাত ভাই রাসেলকে গত বছর দেড়েক সময় ধরে কক্সবাজারে নিয়ে আসেন।
সরেজমিন জানা গেছে, সার্ভেয়ার ফেরদৌস খানের সাথে তার বাসায় থাকেন ফুফাত ভাই রাসেল। প্রতিদিন একটি ব্যাগ নিয়ে রাসেল এলএ অফিসে আসতেন। সন্ধ্যায় টাকা ভর্ত্তি ব্যাগ নিয়ে ফিরতেন বাসায়। র্যাবের অভিযানে ফেরদৌস খানের বাসা থেকে ২৬ লাখ ৮৪ হাজার নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। ফেরদৌস খানের বাসায় তদবিরের কাজ করা মহেশখালী দ্বীপের বাসিন্দা সাবেক ছাত্রদল নেতা খোরশেদ আলমও বসবাস করতেন। র্যাবের অভিযানের পর তারা সবাই এখন পলাতক।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা এলএ অফিসে কর্মরত তিনজন সার্ভেয়ারের বাসায় হানা দিয়ে র্যাব-১৫ ক্যাম্পের সদস্যরা নগদ ৯৩ লাখ ৮০ হাজার নগদ টাকা উদ্ধার করেন। সেই সাথে উদ্ধার করা হয়েছে ৭ বস্তা জমির মূল্যবান কাগজপত্র ও ব্যাংকের চেক। র্যাবের অভিযানে সার্ভেয়ারদের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ব্যাংক অর্থাৎ শুধু সাক্ষরযুক্ত চেক পর্যন্ত।
ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি এবং ডাচ-বাংলার মতো তফসিলি ব্যাংকের চেকই বেশী পাওয়া গেছে সার্ভেয়ারদের দখলে। এভাবেই গত এক বছরের অধিক সময় ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থের চেক নিয়ে পরে সেই টাকা ছাড়িয়ে নিয়েছে গ্রেফতার হওয়া সার্ভেয়ার ওয়াসিম এবং পলাতক সার্ভেয়ার ফরিদ ও ফেরদৌস সিন্ডিকেট। র্যাব ইতিমধ্যে এ ঘটনার বিষয় নিয়ে দুদক আইনে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেছে।
কক্সবাজারের র্যাব-১৫ এর ব্যাটালিয়ান কমান্ডার উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ জানিয়েছেন, ওইদিনের অভিযানে গ্রেফতার হওয়া সার্ভেয়ার বরিশাল সদরের নবগ্রাম, ৫৬ মনসুর কোয়ার্টারের দলিল উদ্দিন খানের পুত্র ওয়াসিম খান (৩৭) র্যাবের কাছে অনেক তথ্য দিয়েছেন। র্যাব সদস্যরা সার্ভেয়ার ওয়াসিম খানের বাসা থেকে উদ্ধার করেন নগদ ৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। তিনি কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণের টাকা কক্সবাজার এলএ অফিসে দায়িত্বে ছিলেন।
র্যাবের অভিযানের পর থেকেই এলএ অফিসে অনুপস্থিত রয়েছেন পটুয়াখালীর বাউফলের বুচিঙ্গার বাসিন্দা আবু বকর সর্দ্দারের পুত্র ফরিদ উদ্দিন (৩৬) সার্ভেয়ার ও রাঙ্গামাটির দক্ষিন কালিন্দিরপর এলাকার ময়নাল খানের পুত্র সার্ভেয়ার ফেরদৌস খান। র্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার শহরে সার্ভেয়ার ফরিদের বাসা থেকে ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকা ও ফেরদৌস খানের বাসা থেকে জব্দ করেন ২৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সার্ভেয়ার ফরিদ ও ফেরদৌস খান মহেশখালী দ্বীপের অধিগ্রহন করা জমির ক্ষতিপূরণ প্রদানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অসাধূ সার্ভেয়ারগন দীর্ঘদিন ধরেই প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বিকালের ফ্লাইটগুলোতে টাকার বস্তা নিয়ে ঢাকা ফিরে যান আবার রবিবার সকালে ফ্লাইটে কক্সবাজার আসেন। কক্সবাজার এলএ অফিসটিতে অধিগ্রহণ করা জমির প্রকল্প অনুযায়ি স্থানীয়ভাবে তিন গ্রুপ ভাগ করে সার্ভেয়ারগন কাজ করছেন। সার্ভেয়ারদের মধ্যে বেপরোয়া বলে অভিযোগ উঠেছে এক নম্বর ও দুই নম্বর গ্রুপে কর্মরত। র্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে হাতেনাতে নগদ টাকা জব্দ সহ আটকের ঘটনাটিও ঘটেছে উল্লিখিত গ্রুপে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-