সমকাল ◑
সোমবার ৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। টেকনাফের নয়াপাড়া মুচনী ক্যাম্পের ই ব্লকের কাপড় ব্যবসায়ী নূর নবীর কাছে চাঁদাবাজি করতে যায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী জকির ও তার সহযোগী আমানসহ ১৫-২০ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের তর্ক শুরু হয়। উত্তেজিত জকির বাহিনী তখন তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। গুলিবিদ্ধ হয় অন্তত ১৪ জন।
পরদিন ৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরে অভিযানে যায় র্যাব। তখন তাদের ওপর হামলা করে জকির বাহিনী। এ সময় পাল্টা গুলিতে মারা যায় জকির বাহিনীর সদস্য ইলিয়াছ ডাকাত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার পরিচয় ছিল ‘সাব মাঝি’। ইলিয়াছ টেকনাফের ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ডি ব্লকের বাসিন্দা। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি দেশি বন্দুক, একটি ওয়ান শুটার গান ও চারটি তাজা কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটাচ্ছে জকির বাহিনী। ক্যাম্পে প্রায় নিয়মিত হানা দিচ্ছে তারা, গুলি চালাচ্ছে, কায়েম করেছে ত্রাসের রাজত্ব। সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গারা জিম্মি হয়ে পড়েছে জকির বাহিনীর কাছে। এ পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি এনজিও কর্মীরাও এখন কার্যক্রম চালাতে শঙ্কা বোধ করছেন।
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক বা ক্যাম্প ইনচার্জদের স্থানীয়ভাবে ‘মাঝি’ বলা হয়। তারা সাধারণত ক্যাম্পের যাবতীয় সমস্যা নিরসনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে কার্যক্রম সমন্বয় করে। অভিযোগ উঠেছে, অনেক মাঝিই রোহিঙ্গা অপরাধী চক্রকে সহায়তা করছে।
কক্সবাজারের র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ সমকালকে বলেন, টেকনাফের রোহিঙ্গা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জকিরকে আইনের আওতায় নেওয়া জরুরি। তাকে ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার শক্ত অপরাধ নেটওয়ার্ক রয়েছে।
কে এই জকির: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে রোহিঙ্গা নাগরিক জকির টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অন্যতম টপ মোস্ট ক্রিমিনাল। দীর্ঘদিন ধরে তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখনও অধরাই রয়ে গেছে সে। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকায় র্যাব-পুলিশের সদস্য পৌঁছানোর আগেই সে পালিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, টেকনাফের নয়াপাড়ার সি ব্লকের আমিনের ছেলে জকির (২৮)। একাধিক বিয়ে করেছে সে। জকিরের নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। তাদের হাতে দেশি অস্ত্র ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় জকির বাহিনী ‘সালমান শাহ বাহিনী’ নামেও পরিচিত।
যেভাবে উত্থান জকিরের: আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, একসময় রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করত নূরে আলম ডাকাত। তার গ্রুপ একজন আনসার সদস্যকে হত্যা করে তার অস্ত্র লুট করেছিল। ২০১৮ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় সে। এরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নেয় সলিম বাহিনী। নূরে আলম ও সলিম দু’জনের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল জকিরের। কিন্তু ইয়াবার মুনাফার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে সলিমকে হত্যা করে জকির বাহিনী। ফলে ক্যাম্পে জকির প্রায় একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, জকিরের ‘ডান হাত’ হিসেবে এখন কাজ করছে ডিবি সাইফুল। জকিরের দুই ভাই জমির, দীন মোহাম্মদ ও শ্যালক বদইয়্যার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। জকিরের নেতৃত্বে আরেকটি পৃথক বাহিনী ‘সালমান শাহ বাহিনী’ও
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয়। এ বাহিনীর প্রায় সব সদস্যের বয়স পঁচিশের নিচে। এই বাহিনী এতই বেপরোয়া যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করতেও ভয় পায় না তারা। এরই মধ্যে জকির বাহিনীর হামলায় র্যাবের দুই সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। এ বাহিনীর হামলায় অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময় আহত হয়েছে।
আয়ের উৎস ইয়াবা মাসোয়ারা: জকির বাহিনীর অর্থের জোগানের একটি বড় উৎস ইয়াবা কারবার। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যেসব সিন্ডিকেট ইয়াবা কারবার করছে, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নেয় তারা। অনেক সময় জকির বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য ইয়াবা কারবারে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। ইয়াবা ছাড়াও ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তারা নিয়মিত মহড়া দেয়। রোহিঙ্গা নারীদের অপহরণেও জড়িত তারা। রোহিঙ্গাদের অন্যখানে পাচার করেও অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই বাহিনী।
সন্ত্রাসকবলিত বিভিন্ন ক্যাম্প: নয়াপাড়া, জাদিমুরা ও লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প বলতে গেলে একক নিয়ন্ত্রণে রেখেছে জকির বাহিনী। একাধিকবার জকির ও তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়েছে পুলিশ-র্যাব।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের পাশে জকির বাহিনীর আস্তানায় অভিযানে গেলে র্যাবের ওপর গুলি চালায় এই বাহিনী। এতে কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর সিপিসি-২ হোয়াইক্যং ক্যাম্পের সদস্য সৈনিক ইমরান ও করপোরাল শাহাব উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন।
স্থানীয় সূত্র বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশে বেশ কয়েকটি পাহাড়ে আস্তানা গেড়েছে জকিরসহ একাধিক অপরাধী চক্র। এ চক্রের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে ছৈয়দ হোছন ওরফে পুতিয়া, খায়রুল আমিনম রজক, ওসমান, লালু, নুরুল ইসলাম ওরফে নুর সালাম, আবদুল হাকিম, হামিদ, রাজ্জাক, মাহনুর ও সালমান শাহ।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-