অনেক প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১০ জানুয়ারি দেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারাদেশ থেকে মানুষ ঢাকায় আসেন প্রিয় নেতাকে একবার চোখের দেখা দেখতে। সকাল থেকেই নেতার আগমনীতে সেজে ওঠে ঢাকা। দীর্ঘ কারাবাসের পর স্বাধীন দেশে ফেরার আগে লন্ডন থেকে ভারতে যাত্রাবিরতি করে তিনি সেখানকার রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে জাতির জনকের মর্যাদাও পান।
ঢাকায় নেমে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে যেতে সময় লাগে ১৩০ মিনিট। পথে পথে নেমে আসে পুরো দেশ। গাছের ডালে, ভবনের বারান্দায়, রাস্তায় এতোই ভিড় যে, গাড়ি চালানো ছিল দায়।
দৈনিক বাংলায় পরের দিন প্রকাশিত সংবাদ বলছে, ‘বহরের প্রথমে পাইলট কার,তার পেছনে দুটো জিপ,তার পেছনে সাংবাদিকদের ট্রাক, ঠিক তারই পেছনে বঙ্গবন্ধুর সুসজ্জিত ট্রাক। নীল ও লাল রঙের কাপড়ের ঘের দেওয়া সেই ট্রাকের ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। পরনে কালো প্যান্ট কালো কোট। ক্লান্ত দেহ অথচ সজীব মুখ। চলন্ত ট্রাকের ওপর তার দুপাশে রয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ।’
ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া ট্রাকে করে রেসকোর্সে নেমে ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণের ধারাবাহিকতাতেই যেন তিনি ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং স্বাধীন থাকবে। এখনও ষড়যন্ত্র চলছে, কিন্তু একজন বাঙালি জীবিত থাকা পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে।’ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রকে আবারও ডাক দেন তিনি— ‘ঘরে ঘরে সতর্ক থাকুন, ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’
পাকিস্তানের ভুট্টোকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা সুখে থাকুন, শান্তিতে থাকুন। আমরাও আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে বদ্ধ পরিকর। ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছিলেন কোনোরূপ একটা যোগসূত্র রাখতে। কিন্তু আর নয়। এবার তারা শান্তিতে থাকুন।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী আপামর জনতাকে বঙ্গবন্ধু পরম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সালাম জানান। তিনি বলেন, ‘আমি সালাম জানাই মুক্তি বাহিনীকে, গেরিলা বাহিনীকে, কর্মী বাহিনীকে। আমি সালাম জানাই সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণিকে, কুষককুলকে, বুদ্ধিজীবীদের।’
বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স
সেইদিন হেলিকপ্টার থেকে চিত্রগ্রহণের দায়িত্বে ছিল চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগ। ১টা ৪১ মিনিটে বিমানবন্দরে নামে তাকে বহনকারী বিশেষ বিমান। এরপর বেলা ২টা ৩১মিনিটে এমপিএ হোস্টেল পর্যন্ত ট্রাক পৌঁছায়। পরের দিনের পত্রিকা ও উপস্থিত ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ফার্মগেট শেরেবাংলা নগর ক্রসিং পার হতে বেলা ৩টা বেজে যায়। রাস্তার অবস্থা এমনই হয়েছিল যে, সেখান থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেতে সময় লাগলো ৪২ মিনিট। অথচ সেদিন রাস্তায় ছিল না অন্যকোনও যানবাহন। ট্রাফিকের ব্যবস্থাপনায় আগের দিনই ঘোষণা ছিল— সুনির্দিষ্ট এই সময়ে সাইকেল রিকশাসহ সব যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞার। হাজারো ফেস্টুনে ভরা পথ, মানুষের আনন্দ উল্লাস, নাচ আর গানের মধ্য দিয়ে বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে প্রবেশ করেন লাখো মানুষের করতালি আর উল্লাসধ্বনির মধ্য দিয়ে।
সেই পাইলট মিস্টার কুক
বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর যে কমেট বিমানে করে ঢাকায় আগমন করেন, সেটি চালিয়ে ছিলেন স্কোয়াডন লিডার মিস্টার কুক। তাকে যে এই বিশেষ বিমান নিয়ে ঢাকায় আসতে হবে, তা তিনি রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ আগেও জানতেন না বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তার সঙ্গে ঢাকায় সাংবাদিকদের কথা হয়। তিনি হেসে জানিয়েছিলেন সেই নাটকীয় বিমানযাত্রার কথা। বাসসে (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা) কর্মরত আবদুস সামাদকে মি. কুক জানান, প্রথমে লন্ডন থেকে বিমানটি এনেছেন মি. হোয়ার্স।আর মি.কুক মাসিরাহ থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় এনেছেন বিমানটি।.”
ঢাকার ছোট রানওয়েতে এই বড় বিমান নামাতে বেগ পেতে হয়েছিল কিনা প্রশ্নে মি. কুক বলেন, ‘সমস্যা হয়নি। তেল কমাতে ঢাকার আকাশে কয়েকটি চক্কর দিতে হয়েছে। তবে এই চক্করের আরেকটি কারণ বঙ্গবন্ধুকে তার ঢাকা দেখানো।’ মি. কুক এও বলেন, ‘আমি গত ১৭ বছর ধরে বিমান চালাই। আলেকজান্ডার এলিজাবেথসহ বহু বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিকে আমি আমার যাত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে যাত্রী হিসেবে পেয়ে গর্ব বোধ করছি।’
আসার আগে দিল্লিতে
নয়াদিল্লির আমন্ত্রণে লন্ডন থেকে প্রথমে সেখানে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে রাষ্ট্রীয় আলাপের পর সংবর্ধনায় বক্তৃতা দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে। দিল্লি ক্যান্টনমেন্টের প্যারেড গ্রাউন্ডে সংবর্ধনায় তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি ভারতের জনগণ, সরকার ও সেনাবাহিনী যে সহানুভূতি ও সমঝোতার মনোভার প্রদর্শন করেছেন এবং এরজন্য তারা যে আত্মত্যাগ করেছেন, তাতেই দুদেশের সম্পর্ক দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের দুস্থ মানবতাকে সহায়তা করার জন্য কোনও চেষ্টাই বাদ দেননি। পিটিআই ও এনা’র বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু বক্তৃতাকালে জানান, আমরা আমাদের সবচাইতে বিপদের দিনে তাদের সহযোগিতা কোনোদিন ভুলবো না।’ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার নীতির মিল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আদর্শ দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের মিল।’ শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে ইংরেজিতে বক্তৃতা শুরু করেন। উপস্থিত কিছু জনতা বাংলায় বলার জন্য অনুরোধ করলে সম্বোধনের পরে তিনি বাংলায় বক্তৃতা দেন।
ইন্দিরা গান্ধী তার বক্তৃতায় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দেহটাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, কিন্তু তার আত্মাকে বন্দি করা যায়নি। বন্দি থেকেও তিনি তার জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছেন।’ ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, ‘তিনি জনগণকে যে তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রক্ষা করেছেন। সেগুলো হলো— উদ্বাস্তুদের গৃহে প্রত্যাবর্তন, মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশের জনগণকে সর্বত্রভাবে সহায়তা এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করা।’
বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নামার পরপরই ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয় এবং দুইদেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভিভি গিরি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারতে স্বাগত জানাতে পেরে প্রগাঢ় আনন্দ অনুভব করছি। আমার সরকার ও জনগণ মহান এই ক্ষণটিরই প্রতীক্ষায় ছিল। আপনি বাস্তবিকই এক নতুন জাতির জনক। আপনার উদ্দীপনাময় নেতৃত্বে উজ্জীবিত হয়েছে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। তাতেই সৃষ্টি হয়েছে একটা নতুন দেশ-বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশ প্রস্তুত
এদিকে কয়েকদিন ধরেই নেতার আগমনের সব প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলার জনগণ। উন্মুখ হয়ে আছে গোটা বাংলাদেশ। রাস্তায় রাস্তায় নির্মিত হয়েছে তোরণ। গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বয়ে আসছে জনস্রোত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ নয়াদিল্লি থেকে একটি বিশেষ বিমানযোগে বিকালে ঢাকা পৌঁছাবেন। ১০ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত লিড স্টোরিতে বলা হয়, ‘১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি দখলদারদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্ররা কারাগারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটকে রাখায় স্বাধীনতার স্বাদ থেকে যায় অপূর্ণ। আজ জাতির জনক ফিরে আসছেন, তার মার্চের সোনার বাংলায়, স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ ফিরে পাচ্ছে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে স্বাধীনতার স্বাদ আজ পূর্ণতা লাভ করবে— জয় বাংলা জয়তু মুজিব।
তিনশ’র বেশি বিদেশি সাংবাদিক
প্রত্যাবর্তনের খবর সংগ্রহে তিনশ’র বেশি বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন বিমানবন্দরে। বাসস জানায়,তারা যেন তাদের সংবাদপত্র টেলিভিশনে ঠিক মতো সংবাদ প্রচার করতে পারে, সেজন্য তাদেরকে ভাড়া করা বিমানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
ইয়াহিয়ার কারাগারে বন্দি থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর ৪২ পাউন্ড ওজন কমেছে বলে সংবাদ প্রচারিত হয়। তিনি জনগণের সামনে এলে তার প্রমাণ মেলে এবং তাকে শীর্ণ ও দুর্বল দেখাচ্ছিল বলে দৈনিক বাংলা সংবাদ প্রকাশ করে। রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেও জানান, তিনি সুস্থ নন এবং আজ দীর্ঘ বক্তৃতা করতে পারবেন না। তিনি বলেন, ‘আমি আগে যেমনটা ছিলাম, সেই শেখ মুজিবুর রহমান নেই। আরেকদিন আপনাদের সামনে বক্তৃতা করবো।’
গণচীন ও ইরানের কূটনীতিক ছিলেন না
ঢাকায় অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে গেলেও গণচীন ও ইরানের কোনও প্রতিনিধিকে দেখতে পাওয়া যায়নি।
সেদিন বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় বলেন, ‘আমার জীবনের স্বপ্ন স্বার্থক হয়েছে। আমার সোনার বাংলা আজ মুক্ত, স্বাধীন। বাংলাদেশ আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিহাসে সর্বদা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে টিকে থাকবে।’ ভারতীয় সৈন্যদের বিষয়ে তিনি জনতাকে বলেন, ‘আমি যে মুহূর্তে বলবো তখনই সমস্ত ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবে।’
ইয়াহিয়া সরকারকে যারা সহযোগিতা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সময় মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ারি জানিয়েছিলেন প্রথম দিনেই। পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের ভিত্তি হবে— স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথক সত্তার প্রতি পারস্পারিক শ্রদ্ধা। অন্য ভাষাভাষীর লোকদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই, বাঙালিরা কেবল স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করে না, তারা শান্তিতেও বাস করতে পারে।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-