বাংলা ট্রিবিউন ◑
কক্সবাজারের সাগরে গোসল করতে নেমে ভেসে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন খুলনা সোনাডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা সাব্বির আহমদের ছেলে দেলোয়ার হোসেন (১৪)। ২৫ ডিসেম্বর এই ঘটনা ঘটে। একদিন পর তার মৃতদেহ উদ্ধার করে কক্সবাজারের ট্যুরিস্ট পুলিশ। এভাবেই সাগরে গোসল করতে নেমে কেউ মা-বাবা, সন্তানকে হারিয়েছেন, আবার কেউ হারিয়েছেন প্রিয়জনকে। একটু আনন্দের আশায় কক্সবাজারে বেড়াতে এসে এভাবেই কান্না চোখে ফিরতে হয়েছে অনেক পর্যটককে।
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৯ সাল অর্থাৎ এই বছরে সাগরে গোসল করতে নেমে পানিতে ভেসে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৯ জন পর্যটক। এসময় জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ২০ জনকে। গতবছল (২০১৮ সালে) ১৩ জন পর্যটক গোসল করতে গিয়ে ভেসে প্রাণ হারিয়েছেন, জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল ৩৭ জনকে।
আরও জানা যায়, গত ১০ বছরে সাগরে গোসল করার সময় ভেসে গিয়ে প্রাণ হারান অন্তত দেড় শতাধিত পর্যটক। এদের বেশিরভাগই সাগরের পানিতে নামার নির্দেশনা না মেনে এবং গুপ্তখালে পড়ে ভেসে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য সাগরে সতর্কতামূলক বিভিন্ন নির্দেশনা রয়েছে। সচেতনতার জন্য এসব নির্দেশনা মাইকে এবং বিভিন্নভাবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই তা মানছেন না। যারা মানছে না, তাদের বেশিরভাগই সাগরে গোসল করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।’
মো. জিল্লুর রহমানের মতে, ‘গোসলের জন্য সংরক্ষিত এলাকা বাদ দিয়ে অনেকে ঝুঁকি নিয়ে অন্য জায়গায় নামছেন। ভাটার সময় গোসলে নামা বিপজ্জনক হলেও তা মানছেন না। সাগরে লাল নিশানা উড়ানো হলেও অনেকে গোসলে নামেন। এছাড়াও সাঁতার না জেনে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া গোসল করা, টায়ার নিয়ে গোসল করা, সাগরে গুপ্তখাল ও গুপ্তচর সৃষ্টি হওয়া- নানা করণে মৃত্যু হচ্ছে পর্যটকদের। এজন্য আমাদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। অবশ্য সাগরে সি-নেটিংয়ের ব্যবস্থা করা হলে প্রাণহানির সংখ্যা একদম কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) মুসা নাসের চৌধুরী বলেন, ‘কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের মধ্যে সতর্কতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রতিদিন হ্যান্ড মাইকে করে সাগরে নামার বিষয়ে সতর্ক বার্তা দেওয়া হচ্ছে। পর্যটকদের সেবায় জেলা প্রশাসন থেকে ৪০ জন বিচ কর্মী ও ৩০ জন লাইফগার্ড সদস্য কাজ করছেন। এছাড়াও সুগন্ধা, লাবনিসহ বিভিন্ন পয়েন্টে তথ্যকেন্দ্র (হেল্প ডেস্ক) খোলা হয়েছে। একইভাবে পুরো সমুদ্র সৈকত জুড়ে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর কারণে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবছর প্রাণহানির সংখ্যা কমে এসেছে।
কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুখিম খাঁন বলেন, ‘প্রাকৃতিক কারণে সাগরে একেক সময় একেকটি পয়েন্টে গুপ্তখাল সৃষ্টি হয়। বর্তমানে সুগন্ধা পয়েন্টে এরকম একটি গুপ্তখাল সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে পুরো সৈকতজুড়ে পানির নিচে সাগরের বালি নরম থাকে। সাগরে স্রোত দুই রকমের হয়। পানির ওপরে কূলের দিকে স্রোতের টান থাকলেও পানির নিচে সাগরের দিকে স্রোতের টান বেশি। স্রোতের গতিবিধি বুঝতে না পেরে পর্যটকরা ভেসে যান। আবার অনেকেই বেশি আনন্দ করতে গিয়ে আবেগে নিজের অজান্তে বেশি পানিতে চলে যান, সাঁতার না জানার কারণে পরে ভেসে যান অথৈ পানিতে।’
মুখিম খানের মতে, ‘সাগরে গোসল করতে গিয়ে মৃত্যুর হার কমাতে হলে প্রশাসনের পাশাপাশি কক্সবাজারে অবস্থানরত হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরও পর্যটকদের সতর্ক করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রতিটি হোটেল-মোটেলে লিফলেট বিতরণসহ সরাসরি সাগরে নামার বিষয়ে সতর্ক করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।’
টুরিস্ট পুলিশের কর্তব্যরত এসআই মিজান বলেন, ‘লাবনি পয়েন্ট ছাড়া সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা, সিগাল, ডায়াবেটিস হাসপাতাল পয়েন্টে গোসলে নামা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। একইভাবে হিমছড়ি, ইনানী, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন সাগরে গোসল না করার জন্য নিষেধ রয়েছে। এসব পয়েন্টে পর্যটকদের সতর্ক করতে একাধিক লাল নিশানা ওড়ানো হলেও কেউ তা মানছেন না। বিপুলসংখ্যক পর্যটকদের রক্ষায় টুরিস্ট পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গোসলে নামার আগে অন্তত একবার জোয়ার-ভাটার তথ্যটা সবারই জেনে নেওয়া উচিত। ভাটার সময় গোসলে নামা বিপজ্জনক। এসময় লাল নিশানা ওড়ানো হয়। আর জোয়ারের সময় ওড়ানো হয় সবুজ নিশান।’
স্থানীয় লাইফগার্ড কর্মীরা জানান, দুয়েকদিন পরেই থার্টিফাস্ট নাইটে বিপুল পরিমাণ পর্যটক সমাগম হবে। এই পর্যটকদের সামাল দেওয়া কঠিন। কারণ কেউই নির্দেশনা মানতে চান না। এছাড়াও সৈকতের লাবনি পয়েন্টে গোসলের জন্য কিছু এলাকা সংরক্ষিত রাখা হলেও পর্যটকরা সৈকতের অন্যান্য বিভিন্ন পয়েন্টেও গোসলে নামেন।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-