বাংলা ট্রিবিউন ◑
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একজন অবিস্মরণীয় নেতা, যার নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং এই প্রতিবাদ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মানুষের সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়। যারা সেসময়ে এই নেতাকে কাছে বা দূর থেকে দেখেছেন তারা বলছেন, এই নেতার অবদান ও তার রাজনৈতিক জীবন পরিপূর্ণভাবে জানা আজও সম্ভব হয়নি। তার দর্শন, তার লক্ষ্য, বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত লোক ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে তার যে নাগরিক বিকাশ, তা ধারণ বা বিশ্লেষণের ক্ষমতা সবার নেই। আর তার সহযোদ্ধা কাণ্ডারিরা বলছেন, তার মতো বিচক্ষণ, দয়ালু নেতা বিশ্বে আর আসেননি। যে নেতাকে বাঙালি হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছে, সেই শেখ মুজিবর রহমান তার বইতে নিজের সম্পর্কে লিখছেন, ‘আমি মুখে যা বলি তাই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না, যা বিশ্বাস করি বলি। সেজন্য বিপদেও পড়তে হয়, এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুণও বলতে পারেন’। (অসমাপ্ত জীবনী, পৃষ্ঠা নম্বর-২১৮)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হবে বছরব্যাপী কর্মসূচির। এই উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে জানার নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, এরইমধ্যে মন্ত্রণালয়গুলো তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এই সেই নেতা যিনি বাংলার হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, যার ডাকে লাখো মুজিবের আদর্শের মানুষ তৈরি হয়েছে এই বাংলায়।
বিবিসি’র এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে শুরু করেন, যে নেতা জীবনের সবটা দিয়ে একটি দেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেই নেতাকে স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পরে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়। তারপর ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে দেওয়ার অপচেষ্টা চলে দীর্ঘদিন। কিন্তু তা কেন সম্ভব হয়নি বলতে গিয়ে এ বছরের ৩১ আগস্ট শোকদিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নথি পড়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতেন না। তিনি পুরো বাংলাদেশকে জানতেন। সব বিষয়ে অবগত ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, আলোর পথের রাজনীতি জনমানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। তিনি মওলানা ভাসানীকে অনেক শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। তিনি মানুষের চরিত্র সহজেই বুঝতে পারতেন এবং সেই অনুযায়ী চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতেন।’
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজীবন সোচ্চার এই নেতাকে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের (সংসদ) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম-সম্পাদক, পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং যুক্তফ্রন্টের টিকিটে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য হিসেবে তিনি তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
বঙ্গবন্ধু বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের কাছে এক বিস্ময়মাখা চরিত্র। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এই নেতার ডাকে লক্ষাধিক মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, দেশের প্রতি ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের এমন নজির এ প্রজন্মের সবাইকে শিহরিত করে তোলে। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া সেই ভাষণের প্রতিটি লাইন যেন অনবদ্য উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী, চিরভাস্বর অমর কবিতার ছত্র । ভাষণের শেষে দীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর অনন্য ঘোষণা, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ যেন ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মনের কথা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে অলক্ষ্যেই যেন রচনা হয়ে যায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। লাখো বাঙালি ৭ মার্চের সেই দিনটিতেই যেন যুদ্ধে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, আড়াই সপ্তাহ পরে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইপিআরে সশস্ত্র হামলা করায় তাদের এই মানসিক প্রস্তুতি শরীরি ভাষায় রূপান্তরিত হতে বেশি সময় লাগেনি। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে গিয়েই তরুণ-যুবক ও মধ্যবয়সীরা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে যাওয়ার তালিকায় নাম লেখান।
শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি সবসময়ই তাদের নিজেদের নেতা মনে করেছেন। কাছের মানুষের জন্য যেমন মানুষ গান লেখে বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে তেমন করেই তৈরি হয়েছে গান কবিতা। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও অংশুমান রায়ের সুরে ‘‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণী, বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ…’ গানটি শুনলে আজও লোম খাড়া হয়ে যায় উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যত গান রচিত হয়েছে ওই গান সবচাইতে হৃদয় স্পর্শ করে, লোম খাড়া হয়ে যাওয়া অনুভূতি আর দ্বিতীয় কোনও গানে হয় না। আমরা এই গান শুনেছি যখন তখন মুক্তিযুদ্ধকাল। আমি সেসময় দেশের ভেতরেই ছিলাম, ভীষণ উদ্বেলিত ছিলাম। সময়টা মুক্তিযুদ্ধের, সময়টা আমাদের তরুণ সময়।’’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে যতই জানতে চেষ্টা করি ততই তার আরও অনেক দিক আমার সামনে বিস্ময় নিয়ে হাজির হয়। তাকে পরিপূর্ণভাবে জানা সম্ভব হয়েছে এটা এখনও আমি মনে করি না। ’ তার মন্তব্য, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধের নামে যা হয় তার সবই প্রায় নান্দীপাঠ। ব্যক্তি মুজিবুর রহমান, তার দর্শন, তার লক্ষ্য, বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত লোক ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে নাগরিক বিকাশ, এসব সবাই ধরতে পারে না। শেখ মুজিবুর রহমানকে আবিষ্কার পুনঃআবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। অসমাপ্ত আত্মজীবনী অনেকের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বার খুলে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নিজে বাম রাজনীতি করতাম। আবেগ থেকে, বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা নিয়ে সমাজতন্ত্র চাইতাম সেসময়। নির্মোহভাবে যদি মুজিবুর রহমানকে তখন জানতে পারতাম তাহলে আমি তখনই শেখ মুজিবের ভক্ত হতাম, তখন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতাম। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি, তার উপলব্ধি, মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে পারা সেসব না জানা থাকলে তাকে বুঝতে পারা যাবে না। শেখ মুজিব আকস্মিকভাবে তৈরি হননি।
বঙ্গবন্ধু বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৪ বছর। এর মধ্যে এক যুগ কেটেছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। বিস্তর কারাবাস এবং পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিচিত্র অত্যাচারও এই আপসহীন নেতার মনোবল ভাঙতে পারেনি। জেলজীবনকেও তিনি অত্যন্ত সৃষ্টিশীলভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর রচনাসম্ভার মূলত জেলজীবনেরই সৃষ্টি। এ ছাড়া দ্বিতীয় বই কারাগারের রোজনামচা। তার রাজনৈতিক জীবনকে এখনও পাঠ হিসেবে বিবেচনা করেন আরেক নেতা তোফায়েল আহমেদ।
তোফায়েল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তার মতো দরদি মনের রাজনৈতিক নেতা বিরল, তিনি পরকে আপন করে নিতে পারতেন। আমার প্রতি তার স্নেহ ভালোবাসা স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে। তিনি আমাকে মাত্র ২৮ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত করে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। আমি তাঁর সঙ্গে বিশ্ব ঘুরেছি, কাছে থেকে দেখেছি বিশ্বের মানুষ তাকে কী পরিমাণ শ্র্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। বঙ্গবন্ধুর অনেক স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন এই নেতা। তিনি সেসব ধরে রাখার জন্য ভোলায় স্বাধীনতা যাদুঘর করেছেন উল্লেখ করে বলেন, অনেক নেতা এসেছে, আসবে; তবে তাঁর মতো নেতা আসেনি আর, তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে জাতিকে তৈরি করেছিলেন।’
স্মৃতির দুয়ার খুলে প্রবীণ এই নেতা আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে অনেক কিছু ভাবি। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন, যেদিন দশ লক্ষাধিক মানুষের সামনে কৃতজ্ঞচিত্তে মহান নেতাকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করতে পেরেছিলাম।’ সেসময় বঙ্গবন্ধুর প্রতিক্রিয়া কী ছিল জানতে চাইলে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমার বক্তৃতায় আমি তাকে সেদিন তুমি করে সম্বোধন করেছিলাম। বলেছিলাম, ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেও মাথা নত করো নাই। বাংলার মানুষ ঋণী, এ ঋণ শোধ করতে পারবো না। যে নেতা যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তান কারাগারে সেই নেতাকে বাঙালি জাতির পক্ষে কৃতজ্ঞচিত্তে এই উপাধি দেওয়া হচ্ছে। সেটি নিশ্চয় সময়োপযোগী ও নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর মর্ম স্পর্শ করেছিল।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-