ডেস্ক রিপোর্ট ◑ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে এতদিন মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ চালিয়ে আসছিল বাংলাদেশ। পাশাপাশি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোকে মিয়ানমারের প্রতি চাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। তবে এবার কেবল আহ্বান নয় মিয়ানমারের সঙ্গে এ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় কূটনীতি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি চাপ বাড়াতে কার্যকরী বহুপাক্ষিক যোগাযোগকেই পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে রবিবার (৮ ডিসেম্বর) রাতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ একদিকে মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সফরে গেছেন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মিয়ানমারকে মুখোমুখি করার জন্য নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ বিন মোমেন। একই ধরনের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দুই দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দুই দেশে সফরের এ ঘটনা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশেষ গুরুত্ব রাখবে বলে ধারণা করছে সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে করা মামলার শুনানিতে অংশ নিতে হেগের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ বিন মোমেন। আগামী ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে এ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এই শুনানিতে অংশ নিতে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকেরও যাওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে, সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে পূর্ব নির্ধারিত দ্বিপক্ষীয় সফরে দেশটির উদ্দেশে রবিবার মধ্য রাতে রওনা দিয়েছেন। তার সফরে উভয় দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু তার সফরের মূল ইস্যু না থাকলেও কয়েকদিনের সফরে এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হবে বলে গত ৪ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় পররাষ্ট্র নীতির একটি অবয়ব স্পষ্টরূপ ধারণ করেছে এবং এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে দেশের দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে একই উদ্দেশ্যে দুটি ভিন্ন দেশে পাঠানোর মধ্য দিয়ে।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিক প্রচেষ্টায় কোনও বিরোধিতা নেই। আমরা দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টাকে বন্ধ করিনি।’
তিনি বলেন, ‘যদিও আমরা প্রথম এক বছর শুধুমাত্র দ্বিপক্ষীয় সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম, যেটি আমার মতে ঠিক হয়নি। এখন আমরা বহুপাক্ষিকভাবে চেষ্টা করছি কিন্তু আমরা কখনই বলিনি যে আমরা দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টা বন্ধ করে দিচ্ছি। যেহেতু দ্বিপক্ষীয় চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে সে কারণে আমি এরমধ্যে কোনও স্ববিরোধিতা দেখি না।’
তার মন্তব্য, আমরা জানি এটি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত থাকবে। তাই চাপও অব্যাহত থাকুক, পাশাপাশি আমরা দ্বিপক্ষীয়ভাবে চেষ্টা করতে থাকি।
তিনি বলেন, ‘আমরা দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনা বন্ধ করলে মিয়ানমার এটিকে পাবলিসিটি স্ট্যান্ট হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। বলতে পারে যে আমরা সমাধান করতে চাই কিন্তু বাংলাদেশ চায় না; কারণ এই ইস্যুতে দেশটির কর্মকর্তারা অহরহ মিথ্যা বলে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক ডিফেন্স অ্যাটাশে মোহাম্মাদ শহীদুল হক বলেন, ‘আমার সময়ে তিন বাহিনীর প্রধানের সফরের ব্যবস্থা আমি করেছিলাম। তবে এবারে সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেনাপ্রধানকে গোটা বিষয়টি অবহিত করেছেন যা এই সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে।’
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সফরের আগে গত ৪ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। তবে এ সফরে রোহিঙ্গা ইস্যু মূল আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে থাকবে না ইঙ্গিত দিয়ে জেনারেল আজিজ বলেন, ‘সফরে প্রসঙ্গেক্রমে রোহিঙ্গা নিয়ে কথা হবে, এটি নিয়ে কী কী সমস্যা হচ্ছে সেটি নিয়ে আলোচনা হবে।’
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফর
এদিকে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি নেদারল্যান্ডসে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মুখোমুখি হওয়ার আগে তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। সুচি রোহিঙ্গাদের ওপর ওই দেশের আর্মির নৃশংস নির্যাতনের বিরুদ্ধে করা মামলায় শুনানিতে দেশের পক্ষে লড়াই করবেন।
এ বিষয়ে তৌহিদ বলেন, ‘চীন স্পষ্টভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন করছে এবং তারা এটি নিয়ে কোনও গোপনীয়তার আশ্রয় নিচ্ছে না। কাজেই এই সফরটি মিয়ানমারকে সমর্থন করারই একটি অংশ।’
চীন চায় মিয়ানমারের অবস্থান সঠিক থাকুক জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা সমর্থন দেওয়ার জন্য গেছে বা কোনও পরামর্শ দিতে গেছে, যেটি আমরা জানি না এবং এটি হয়তো ভবিষ্যতে জানা যাবে। তবে এটি স্বাভাবিক।’
এ বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘চীন-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে এবং আমার ধারণা চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন।’
গত মাসে বিমান-বিধ্বংসী মিসাইলসহ বিপুল পরিমাণ চাইনিজ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সীমান্ত এলাকা থেকে উদ্ধার করেছে মিয়ানমার এবং এই অস্ত্র উদ্ধারের জন্য উদ্বেগে আছে মিয়ানমার বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, অভিযোগ আছে চীনের সমর্থন নিয়ে কয়েকটি বিছিন্নতাবাদী দল মিয়ানমারে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং চীন তাদেরকে দর কষাকষির সময়ে ব্যবহার করে থাকে।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার এখন চাপের মধ্যে আছে এবং স্বার্থ উদ্ধারের আলোচনার জন্য চীন ঠিক সময়টি বেছে নিয়েছে।’
সুচির অবস্থান
মিয়ানমার সেনাবাহিনী দুই দশকের বেশি সময় ধরে অন্তরীণ করে রেখেছিল অং সান সুচিকে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসাবে পরিচিত সুচি এখন ওই জনগোষ্ঠীরই নেতা, যাদেরকে গণতন্ত্র দিতে সর্বত বাধা দিয়েছিল সেনাবাহিনী। এখন ওই সেনাবাহিনীকেই রক্ষা করার জন্য ডিসেম্বরের ১০-১২ শুনানিতে অংশগ্রহণ করবেন সুচি।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ বলেন, ‘সুচির সামরিক বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং চীনের সঙ্গে এ বিষয়ে সখ্যতা অব্যাহত রাখা এ দুটির কোনোটাই অপ্রত্যাশিত নয়। সুচির সামনে নির্বাচন আছে এবং আগেরবার সুচি ক্ষমতায় এসেছেন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে। এখন সুচি সরকারের অংশ এবং সেনাবাহিনীও সরকারের অংশ। কাজেই সেনাবাহিনী অপকর্ম বা অন্য যা কিছুই করুক সেটিকে সুচি সমর্থন করেই গেছেন।’
তিনি বলেন, তবে সুচি গণতন্ত্রের জন্য যখন সংগ্রাম করছিলেন এবং বাকি পৃথিবীর সমর্থন পাচ্ছিলেন তখন বিষয়টি ছিল একরকম। কিন্তু, এখন সেনাবাহিনী এবং সুচি একইপক্ষে, কারণ তারা ক্ষমতা ভাগাভাগি করছেন।
পশ্চিমা বিশ্বে সুচির অবস্থান আগের মতো আছে কিনা জানতে চাইলে তেমনটা আছে বলে মনে করেন না সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব। তৌহিদ বলেন, ‘তারা চায় সমস্যাটার সমাধানের মাধ্যমে সুচির অবস্থান ঠিক থাকলে ভালোই হয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বেও যেসব দেশের সুচির ওপর আস্থা ছিল তারাও অসন্তোষ ব্যক্ত করছে অথবা তার অবস্থানকে সমর্থন করছে না।’
একই মত পোষণ করে সাবেক ডিফেন্স এ্যাটাশে মোহাম্মাদ শহীদুল হক বলেন, ‘সুচি সামনের বছরের নির্বাচনকে মাথায় রেখে তার সেনাবাহিনীকে রক্ষা করার জন্য হেগে যাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘এর ফলে দেশে তার জনপ্রিয়তা বাড়বে এবং আগামী নির্বাচনে তার ভালো ফল করার সম্ভাবনা আছে।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-