ডেস্ক রিপোর্ট ◑ টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ নিয়ে একটি বড় ধরণের কেলেংকারি উদঘাটন করা হয়েছে। প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে টন টন পেঁয়াজ আমদানির তথ্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হলেও বাস্তবে দেখা গেছে, আমদানির অর্ধেক পরিমাণও বাজারে ছাড়া হচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ, শুল্ক বিভাগ, আমদানি কারক এবং সি এন্ড এফ এজেন্টসহ সবাই মিলে সিন্ডিকেট গঠণের মাধ্যমেই আমদানির তথ্য দিয়ে সরকার এবং দেশের জনগনের সাথে অহেতুক জালিয়াতি ও প্রতারণা করে আসছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন গতকাল বৃহষ্পতিবার বিকালে জানিয়েছেন-‘ টেকনাফ সীমান্তের পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের আমদানির জালিয়াতি ও প্রতারণার তথ্য পেয়ে আমি আজই (গতকাল) একটি টাস্কফোর্স তদন্ত কমিটি গঠণ করে দিয়েছি। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (এডিএম) মোঃ শাজাহান আলীকে প্রধান করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সমন্বয়ে এ কমিটি গঠণ করা হয়েছে।’ কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, গত কয়েক মাস ধরে চলে আসা এমন ‘সিন্ডিকেট প্রতারণা’র প্রাথমিক ঘটনা বুধবার বিকালে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। পরবর্তীতে গতকাল বৃহষ্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশের তদন্তে দেখা গেছে, এমন জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনার ভয়াবহতা রয়েছে অনেক গভীরে পর্যন্ত বিস্তৃত। তদন্তে আরো দেখা গেছে, আমদানি কারক, শুল্ক কর্তৃপক্ষ, সিএন্ডএফ এজেন্ট ও বন্দর কর্তৃপক্ষের লোকজন মিলে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই শত শত মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির তথ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়ে থাকে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল গতকাল সকাল থেকে বন্দরে প্রাথমিক তদন্তে দেখতে পান, বাস্তবে বাজারে আমদানি করা পেঁয়াজের খবর নেই। টেকনাফের পেঁয়াজ সিন্ডিকেট আমদানি দেখালেও স্বল্প পরিমাণ করে পেঁয়াজ বাজারে ছাড়ছে মাত্র। তার নেপথ্য কারণ জানতে গিয়ে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তকারি কর্মকর্তারা যে তথ্য পেয়েছেন তা হচ্ছে-বাজারে দীর্ঘ মেয়াদী সংকট লেগে রেখে বেশী দামে পেঁয়াজ বিক্রির মাধ্যমে কাড়ি কাড়ি টাকা বানানোর ফন্দি। টেকনাফ স্থল বন্দরে গতকাল পুলিশের তদন্তকারি দল নিশ্চিত হয়েছে যে, মিয়ানমারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানি কারকরা কিনছেন ৩২ টাকা করে।
সেই পেঁয়াজ টেকনাফ সীমান্তে ট্রাকে উঠা পর্যন্ত কেজি প্রতি খরচ দাঁড়ায় ৪০ টাকা করে। সেই পেঁয়াজই বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে কেজিতে ২০০ টাকার বেশী। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে মুনাফা হচ্ছে ১৫০ টাকা। পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, সীমান্তে পেঁয়াজ আমদানিতে যে মুনাফা পাওয়া যায় তা ইয়াবা কারবারকেও হার মানিয়েছে। গত আগষ্ট মাসে পেঁয়াজের সংকট শুরু থেকেই মিয়ানমার থেকে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানিকারকের সংখ্যা হচ্ছে ৩৫/৪০ জন। সেই থেকেই টেকনাফ বন্দর ভিত্তিক গড়ে উঠে পেঁয়াজের একটি বড় সিন্ডিকেট। স্থানীয়দের মতে যদি প্রথম থেকেই সিন্ডিকেট না হয়ে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করা হত তাহলে মিয়ানমারের পেঁয়াজেই দেশের বাজারের সংকট অনেকখানি নিরসন করা সম্ভব হত।
দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হলেও খোদ টেকনাফ-কক্সবাজারের স্থানীয় বাজারেও দামের কোন প্রভাব না পড়ায় জনমনেও নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। তারপরেও এত দীর্ঘদিনেও টেকনাফে সিন্ডিকেট গঠণ সহ সিন্ডিকেটের গোপন কারসাজির তথ্যটি এ পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন-‘ পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বুধবার এক অজ্ঞাত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টেকনাফে সিন্ডিকেট কারসাজির কথাটি জানতে পারেন। আমি এ তথ্যটি পেয়ে টেকনাফ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) রাকিবুল ইসলামকে তাৎক্ষনিক প্রাথমিক তদন্তের নির্দ্দেশ দিই।’
জেলা পুলিশ সুপারের নির্দ্দেশনা পেয়ে টেকনাফ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) বুধবার বিকালে টেকনাফ স্থল বন্দরে যান। বন্দর গেইটে আকস্মিক একজন পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতি দেখে বন্দর কর্তৃপক্ষের লোকজন তাকে প্রথমে সেখানে ঢুকতে বাঁধা প্রদান করেন। তাদের কোন রকমে রাজি করিয়ে পরিদর্শক রাকিবুল বন্দর অভ্যন্তরে ঢুকে পেঁয়াজ আমদানির তথ্য জানতে চাইলে নুছাপ্রু রাখাইন নামের স্থানীয় শুল্ক বিভাগের একজন সহকারি কমিশনার কিছুই জানাতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি বন্দর ও শুল্ক কর্মকর্তারা মিলে এসব কাজ তদারকি করার ক্ষেত্রে পুলিশ পরিদর্শক রাকিবুল ইসলামকেই রিতীমত তারা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন।
পুলিশ পরিদর্শক রাকিবুল বলেন-এসব ঘটনা থেকেই তিনি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হন যে, এখানে বড় কোন কেলেংকারির ঘটনা ঘটছে। তারপরই পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দ্দেশে গতকাল সকাল থেকে পুলিশের দলটি তদন্তে গিয়ে প্রাথমিক ভাবে কেলেংকারির ঘটনা উদঘাটন করেন। এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা আরো বলেন, আমদানি কারকরা বিনা শুল্কে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ পেয়ে হাজার হাজার ডলার মিয়ানমারে পাচার করছেন। সেই সাথে পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে একদিকে দেশের জনগনের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে অপরদিকে সরকারের বিরুদ্ধেও পেঁয়াজ নিয়ে বদনামের অংশিদার করা হচ্ছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ান জানিয়েছেন, তিনি গতকাল তদন্ত করে দেখেছেন যে, গত অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে ৪২ হাজার ৪০৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। সেই হিসাবে দৈনিক গড়ে ৭০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ মিয়ানমার থেকে আমদানি করা হচ্ছে। মূলত আমদানির কাগজ পত্র সহ বিল অব এন্ট্রি পর্যন্ত ঠিক দেখানো হলেও সিন্ডিকেট কারসাজিতে এ পরিমাণ পেঁয়াজের মধ্যে বাস্তবে কত পরিমাণ বাজারে ছাড়া হয়েছে তার কোন প্রমাণ সংশ্লিষ্টরা দেখাতে পারেনি। আমদানির কাগজ পাওয়া গেলেও বন্দর থেকে ট্রাকে মাল ডেলিভারির কোন কাগজ-প্রমাণ নেই। কেবল মাত্র গত ২৫ নভেম্বর এক হাজার বস্তা ও ৩০ নভেম্বর এক হাজার ৮০০ বস্তা আমদানি করা পেঁয়াজেরও কোন হদিস বন্দর, আমদানিকারক এবং সিএন্ডএফ এজেন্ট কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেনি।
এভাবে পুলিশ কর্মকর্তাদের আশংকা হচ্ছে, আমদানির দৈনিক চিত্র দেখানো হলেও বাস্তবে অর্ধেকও বাজারে ছাড়া হয়না। বাদবাকি পেঁয়াজ নাফনদের ওপারে মিয়ানমারের গুদামেই মওজুদ থেকে যায়। বাংলাদেশের বাজারে সংকট বিরাজমান রেখে টেকনাফ সিন্ডিকেট মিয়ানমারের গুদামে রেখে কেজিতে ১৫০ টাকার মুনাফা নিশ্চিত করার জন্যই এমন জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে বলে মনে করছেন পুলিশ। এসব বিষয় নিয়ে জানার জন্য টেকনাফের শুলক্ব কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা ও বন্দর কর্তৃপক্ষের কোন কর্মকর্তাকে মোবাইল সংযোগে পাওয়া যায়নি।
/আজকের দেশ-বিদেশ
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-