ডেস্ক রিপোর্ট ◑ শরীরের বিভিন্ন অংশে পচন ধরেছে; রাস্তায়, ফুটপাতে পড়ে থাকা স্বজনহীন এ মানুষগুলোকে দেখে পথচারীরা নাকে রুমাল চেপে অন্য পাশ দিয়ে চলে যান। এমনকি সরকারি হাসপাতালেও যাদের ঠাঁই হয় না, শরীরে ক্ষত নিয়ে মৃত্যু-যন্ত্রণায় ধুকছেন- এমন অসহায় মানুষের চিকিৎসা দিয়ে বেড়ান যে সাত মহৎপ্রাণ ব্যক্তি, তারা আসলে পুলিশের লোক।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের এ সাত সদস্য নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে গত ৯ বছর ধরে এই সেবা দিয়ে আসছেন। তবে দীর্ঘদিন পর এবার নিজেদের প্রকাশ করেছেন তারা। তাও কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া থেকে নয়। পরিচয় গোপন রেখে এমন কাজ করতে গিয়ে নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়েছেন তারা। সে কারণে পথের রোগীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারস্ত হয়েছেন তারা। তাদের সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ গঠন করতে যাচ্ছে ‘মানবিক পুলিশ ইউনিট’। ইতোমধ্যে এ ইউনিটের জন্য তহবিল গঠনের কাজ শুরু হয়েছে।
এ সাত পুলিশ হলেন- নগরের দামপাড়া বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালের শওকত হোসেন, মো. হান্নান, মো. মাঈনুদ্দীন, মাহবুবুল আলম, ইয়াছিন আরাফাত, রবিউল হোসেন ও এমরান হোসেন। মূলত কনস্টেবল শওকতের উদ্যোগেই ২০১১ সালে এ কাজে শামিল হয়েছিলেন অন্যরা। পরিচয় গোপন রেখে নিজেদের টাকায় তারা সেবা দিতেন। বিষয়টি নগর পুলিশের কর্মকর্তাদেরও নজরে ছিল না। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং অর্থ জোগাতে হিমশিম খাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের মাসিক কল্যাণ সভায় নিজেদের এই কাজের কথা তুলে ধরে সহযোগিতার আর্জি জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহাবুবর রহমান বলেন, তারা সবার অগোচরে যে মানবিক কাজটি করে যাচ্ছেন, সেটি শুনে আমি অভিভূত। যারা মানবতার সেবায় এসব কাজ করে আসছেন এবং করতে চান, তাদের সবাইকে একত্র করে, একটি ইউনিট গঠন করেছি। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তহবিলেরও ব্যবস্থা করেছি।
২০০৫ সালে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন শওকত হোসেন। পাঁচ বছর পর ঢাকা থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। নার্সিং ও প্যারামেডিক ডিপ্লোমাধারী হওয়ায় পদায়ন হয় দামপাড়া পুলিশ হাসপাতালে। তখন তার কাজ ছিল গুরুতর অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। ২০১০ সালের মাঝামাঝি এক পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে রাস্তার পাশে এক মানসিক ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে দেখেন তিনি। যার শরীরের একাংশে পচন ধরেছিল। সেই ব্যক্তিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে দেন। পরদিন গিয়ে দেখেন হাসপাতালে সেই ব্যক্তি নেই। এভাবে বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন তিনি। কিন্তু তারা কেউ হাসপাতালে থাকেন না। পরে পথেই তাদের চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শওকত।
শওকত হোসেন জানান, পথের যেসব লোকের শরীরের ম্যাগোট (শরীরের ক্ষত স্থানে পোকা ধরে যাওয়া) ইনফেকশন হয়, তাদের কাছ থেকে প্রচুর দুর্গন্ধ ছড়ায়। তারা চলাফেরা করতে পারেন না। যেখানে থাকেন, সেখানেই মলমূত্র ত্যাগ করেন। তাদের আশপাশে কেউ যেতে চান না। পথে থাকেন বলে তারা চিকিৎসাও পান না। বিষয়টি তাকে স্পর্শ করে। ম্যাগোট রিপেয়ারিং কোর্স করা থাকায় নিজেই তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন।
শওকত যেভাবে এলেন এমন মহৎ কাজে- ‘২০১১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের ডাস্টবিনের পাশে বাক ও মানসিক প্রতিবন্ধী এক লোককে দেখতে পাই। সেই লোকের বাঁ পায়ে ক্ষত ছিল। সেখানে পোকা বাসা বেঁধেছে। তাকে চিকিৎসা দেওয়ার মাধ্যমে প্রথম কাজ শুরু করি। শুরুতে নিজের পুরোনো কাপড় নিয়ে ব্যারাকের সহকর্মীদের নিয়ে যেতাম ওই ব্যক্তিকে সেবা করার জন্য। একদিন পরপর গিয়ে তাকে সেবা দিয়েছি চার মাস। ম্যাগোট সারিয়ে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে অপারেশন করে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলি।’
এভাবে একাই বছরখানেক স্বজনহীন রোগীদের সেবা দেন শওকত। নিজের টাকায় সেবা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়লে সহকর্মীদের বিষয়টি জানান। তার আহ্বানে এগিয়ে আসেন কনস্টেবল মাঈনুদ্দিন, আনোয়ার ও মিরাজ। তারা টাকা দেওয়ার পাশাপাশি শওকতের কাজে সহযোগিতা শুরু করেন। তাদের দেখে এগিয়ে আসেন রেজাউল ও আল আমিন। দুই বছরের মধ্যে মাঈনুদ্দীন ছাড়া অন্য সবাই চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে যান। কিন্তু দমে যাননি শওকত। তার পাশে এগিয়ে আসেন হান্নান, মাহবুবুল আলম, ইয়াছিন আরাফাত, রবিউল হোসেন ও এমরান হোসেন।
পুলিশের চাকরির পাশাপাশি সময় পেলেই পথে পড়ে থাকা রোগীদের পাশে দাঁড়ান তারা। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে কাজ করার পর সাতজনের মধ্যে যাদের ডিউটি থাকত না তাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন শওকত। নিজেদের প্রতি মাসের বেতন থেকে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতেন এসব রোগীর পেছনে। এ বছরের শুরু থেকে অন্তত ৩৯ জন রোগীকে তারা সেবা দিয়েছেন। অনেকে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন।
শওকত হোসেন বলেন, ‘পুলিশের চাকরির পাশাপাশি স্বজনহীন পথে পড়ে থাকা রোগীদের সেবা দেওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এরপরও সহকর্মীদের নিয়ে আমরা সেটা করেছি। ম্যাগোট রিপেয়ার ট্রেনিং ছাড়া এসব রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। আর এই চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ওষুধ, খাবার, কাপড়- সবকিছুর ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হতো। রোগী বেড়ে যাওয়ায় অর্থ জোগান দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাই এতদিন পরিচয় গোপন রেখে সেবা দিলেও বিষয়টি কল্যাণ সভায় জানিয়েছি।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-