বিশেষ প্রতিবেদক •
একটি এক কক্ষের বাঁশের বেড়া ও টিনের ছাউনি দু’চালা ঘর দেখিয়ে কবির আহামদ(৬০) বলেন, আমরা এধরনের ঘর চাইনি। এটি কি ঘর হলো। আম কাঠের তখ্তা দিয়ে বানানো হয়েছে দরজা ও জানালার পাল্লা। ঘর করে দিয়েছে ১৫/২০ দিন হয়,অথচ এখনি তা খোলা মেলা করা যায় না। কথা গুলো ক্ষোভের সাথে বলেন, কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের পশ্চিম পালংখালী গ্রামের কবির আহামদ।
একটু দূরে আরেকটি ঘর।সেটি দেয়া হয়েছে আবুল হোসেন (৪৩) কে। তিনি জানালেন, এ ধরণের ঘরে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকার কোন পরিবেশ নেই। ঘরের চারপাশে যে বেড়া দিয়েছে তাতে ভেতর- বাইরের সব কিছু দেখা যায়। দরজা,জানালা খোলা বন্ধ করা যায় না। ফ্লোরে এক দেড় ইঞ্চির ঢালাই দিয়েছে ঢালাও ভাবে। মাটিে উপর কয়েকটি ইট বসিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বানিয়েছে, যা ভেঙ্গে যাচ্ছে।
স্হানীয় ইউপি মেম্বার নুরুল হক বলেন,যে ঘর দিয়েছে তাতে মানুষ বসবাসের মত নয়। চালের ঢেউ টিন গুলো মোটামুটি ভাল। অন্য মালামাল গুলো খুবই নিন্মমানের। ঘরের চর্তুদিকের বেড়া দেয়া হলেও উপরে নিচ দুটি বাটাম দেয়া হলেও অন্তত আরো দুটি বাটামের প্রয়োজন হলেও দেয়া হয়নি। এসব ঘরের স্হায়িত্ব নিয়ে তিনি সন্দেহ পোষণ করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সুইস রেড ক্রসের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি – বিডিআরসিএস এর পপুলেশন মুভমেন্ট অপারেশন -পিএমও প্রোগ্রাম ঘর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রীর “জমি আছে ঘর নাই ” কর্মসূচীর আওতায় রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার হত দরিদ্র লোকজনদের বিনামূল্যে এসব ঘর দেয়ার কথা। উপকার ভোগী মনোনয়নে স্হানীয় ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যান,উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বা মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার কথা।
কিন্তু বিডিআরসিএস এর পিএমও উল্লেখিত কারো মতামতের তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছে মত যত্রতত্র ঘর বানিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে স্হানীয় ভাবে প্রকৃত ভাবে যারা ঘর পাওয়ার উপযোগী তাদের অনেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্দেশনা ছিল যাদের নুন্যতম বা ৫ শতাংশ জমি রয়েছে অথচ ঘর নেই তাদেরকে ঘর দেয়ার কথা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের সুপারিশ পত্রকে অগ্রাধিকার প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। দেখা গেছে এসব নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে পিএমওএর লোকজন সরকারী রক্ষিত বনভূমিতে ঘর করে দিয়েছে।
পালংখালী ইউনিয়নের পশ্চিম পালংখালী গ্রামের মৃত কবির আহামদের ছেলে হারুন রশীদ (৩৫) স্ত্রী ছেলে মেয়ে ও বিধবা মাকে নিয়ে পৈত্রিক ১২ শতাংশ জমিতে সরকারী টিনের বেড়া ও পলিথিনের ছাউনিতে কষ্টে জীবন কাটালেও একটি ত্রাণের ঘর পায়নি। পাশ্ববর্তী বেশ স্বচ্ছল,টিনের বাউন্ডারি দেয়া লোকজনদের দেওয়া হয়েছে ত্রাণের ঘর।
পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি এম এ মন্জুর বিডিআরসিএস এর প্রদত্ত ঘরের মান নিয়ে ও উপকার ভোগী নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কারা কাকে কি পরিমাণের কোন ধরণের ঘর দিচ্ছে সে সম্পর্কে কিছুই জানি না। এসব ঘর প্রদানে ও নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেন তিনি।
পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন,বিডিআরসিএস এর লোকজন আমার ইউনিয়নে ৪৪০ টি ঘর বানিয়ে দেবে বলে জানিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী আমি কিছু তালিকাও দিয়েছিলাম। পালংখালী ইউনিয়নে প্রায় ৭/৮ লক্ষ রোহিঙ্গার অবস্থান। সে অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এ ইউনিয়ন। পরে জানতে পারি আমার এখানে ৪৪০ টির মধ্যে মাত্র ২২৫ টি ঘর দিয়ে বাকী ঘর গুলো রোহিঙ্গা অবস্থান থেকে ১০-১৫ কিমি দূরে হলদিয়া ও রত্নাপালং ইউনিয়নে দেওয়া হচ্ছে। এটা অনিয়ম ও দূর্ণীতি বলে তিনি জানান।
বিডিআরসিএস এর পিএমও প্রোগ্রামের কক্সবাজার উপ পরিচালক মোঃ জয়নাল এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে শেল্টার কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলেন।
সিনিয়র শেল্টার অফিসার কামরুল হাসান নিন্মমানের ঘর নির্মাণ,উপকারভোগী নির্বাচন সহ সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে উনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্প কাজ চালানো হচ্ছে বলে দাবী করেন।
নির্দেশনা অনুসরণ করে যাদের নিজস্ব খতিয়ানের জমি রয়েছে তাদেরই শুধু ঘর দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান। পালংখালী ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দকৃত ৪৪০ টি ঘরের মধ্যে ২২৫ টি পালংখালী ইউনিয়নে দেয়া হয়েছে। বাকী ১২৫ টি হলদিয়া পালং ও ৭৫ টি রত্নাপালং ইউনিয়নে উখিয়া ইউএনওর পরামর্শে দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান। প্রতিটি ঘরের ব্যয় বরাদ্দ ৬০-৬৫ হাজার টাকা বলে তিনি জানান।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ঘর দেওয়ার পূর্বে বিডিআরসিএস এর লোকজনদের বলেছিলাম কিভাবে উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে, কারা উপকার ভোগী, কি ধরণের ঘর হবে,কি পরিমাণের ব্যয় বরাদ্দ ইত্যাদি বিষয় জানাতে বলা হলেও এ পর্যন্ত তা তারা জানায়নি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর “জমি আছে ঘর নাই ” কর্মসূচীর নীতিমালা অনুসরণের জন্য বলা হলেও তারা তা মানেনি।
সরকারী জবর দখলকৃত বনভূমিতে পালংখালী ইউনিয়নে বেশ কিছু ঘর দেয়ায় সেখান থেকে কিছু ঘর অন্য ইউনিয়নে দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত ঘর গুলো নিয়েও একই অভিযোগ আসছে বলে তিনি জানান। প্রতিটি ঘরের ব্যয় বরাদ্দ প্রায় ১ লক্ষ ২৫-৩০ হাজার টাকার মত হবে বলে ইউএনও জানান।
উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন,বিডিআরসিএস এর ঘর নির্মাণ ও অনিয়মের বেশ লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তবে কারা, কার মাধ্যমে, কিভাবে ঘর গুলো নির্মাণ করতেছে সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। তাছাড়া একজনের খতিয়ানভুক্ত জমিতে আরেকজনকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া বেআইনি। বিষয়টি তিনি তদন্ত করে দেখছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-