মোস্তফার নিয়ন্ত্রণে দুবাই কেন্দ্রিক অনলাইন জুয়া সিন্ডিকেট

আজিম নিহাদ :


দৃশ্যমান কোন পেশা নেই। সার্বক্ষণিক বাসায় বসে ব্যস্ত সময় পার করতেন। লেনদেন করতেন লাখ লাখ টাকার। পরিচিতজনদের কাছেও তাঁর ‘সোর্স অব ইনকাম’ নিয়ে রীতিমত রহস্য ছিল। কিন্তু সবার দৃষ্টিতে ভদ্রবেশী সেই যুবককে বৃহস্পতিবার জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অনলাইন কেন্দ্রিক জুয়া খেলার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর মোহাম্মদ মোস্তফা। তিনি শহরের ৬নং ঘাট এলাকার হাফেজ আহম্মেদের ছেলে।

ডিবি পুলিশের দাবী, অনলাইন কেন্দ্রিক জুয়ার আসরে কক্সবাজারের যে ক’জন নেতৃত্ব দেয় তাদের একজন মোস্তফা। খেলার জন্য ডলার বিক্রি, জুয়াড়িদের সুদে ঋণসহ জুয়ার নানান ক্ষেত্র ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। তাঁর খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন শত শত লোক। মূলত অনলাইন জুয়ার মূলহোতা তিনি। শুধু কক্সবাজারে নয়, দুবাই, কাতারসহ বিভিন্ন দেশের জুয়াড়িদের একটি বিশাল সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ করেন মোস্তফা।

সূত্রে জানা গেছে, মোস্তফা দীর্ঘদিন ধরে অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত। তিনি নতুনবাহারছড়া, গাড়ির মাঠ, নুনিয়ারছড়া, পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে মধ্যম বাহারছড়া, টেকপাড়া, পাহাড়তলী, কালুরদোকানসহ শহরের বিভিন্ন এলাকার অনলাইন জুয়াড়িদের বিশাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। মোস্তফা গ্রেপ্তারের খবর সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা গা ঢাকা দিতে শুরু করেছে। তবে শহরের প্রায় সব অনলাইন জুয়াড়িদের গোয়েন্দা পুলিশ সনাক্ত করেছে। তারা বর্তমানে কড়া নজরদারিতে রয়েছে। তাদেরকেও গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে।

অনলাইন জুয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের পশ্চিমপাশের মধ্যমবাহারছড়া এলাকায়। এই সিন্ডিকেটের আড্ডা বসে খোদ পুলিশ সুপার অফিসের মোড়েই। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেটটি অধরা।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কর্মকর্তা মাসুম খান বলেন, ‘মোস্তফাকে দীর্ঘদিন ধরে নজরদারিতে রাখা হয়। নানাভাবে তার অনলাইন জুয়ার ব্যবসা ও ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের উপরও নজরদারি জোরদার করা হয়। এর ভিত্তিতে মোস্তফাকে আটক করা হয়েছে। আমাদের কাছে তথ্য ছিলো মোস্তফা পালানোর চেষ্টা করছিলো।’
তিনি আরও বলেন, মোস্তফা অনলাইন জুয়ার মূলহোতা। তার সিন্ডিকেটের অনেক সদস্যকে সনাক্ত করা হয়েছে। তাদেরকেও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

অনলাইন জুয়া এবং জুয়াড়িদের সম্পর্কে অবগত এমন কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, মোস্তফার খপ্পরে পড়ে অনেকে দেউলিয়া হয়ে গেছে। কারণ খেলতে গিয়ে অনেকে টাকা হারিয়ে তার কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিত। সেই টাকার সুদ পরিশোধ করতে না পেরে অনেকের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। কারণ ১০০ জন একসঙ্গে খেললে বিজয় হয় মাত্র ৬ থেকে ৭ জন। বাকিরা পথে বসে। আসক্তিতে পড়ে অনেক অনলাইন জুয়াড়ি মাদক (ইয়াবা) ব্যবসার সাথেও জড়িয়ে পড়েছে। জুয়াড়িদের মাধ্যমের মাদকেও মোস্তফার নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে ওই সূত্রের দাবী। এই জুয়া বন্ধ করতে না পারলে সমাজে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে বলে দাবী তাদের।

সূত্রমতে, জুয়ার আসরে চলমান অভিযানের আড়ালে রমরমা ছিল অনলাইনে জুয়া। অনলাইনে ওয়েবসাইট ‘বেট ৩৬৫’ বা ‘বেট এশিয়া ৩৬৫’-এ একাউন্টের মাধ্যমে চলছে এই জুয়ার আসর। কারো হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকলেই খেলা যায়। অনলাইনে টাকার জায়গায় ডলারে এই জুয়া খেলছে জুয়াড়িরা।

প্রতিদিন হাজার হাজার ডলার বাজি চলছে। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কাজ করছে।

গোয়েন্দা সূত্রমতে, খেলার নেশাকে ছাপিয়ে খেলাধুলা বিষয়ক জুয়ার নেশায় সর্বশান্ত হয়েছেন অনেকে। কেউ সর্বশান্ত হতে চলেছেন, কেউ আবার সর্বস্ব হারিয়েছেন। এমন পরিস্থিতির পেছনে নীরবে ভূমিকা রেখে চলেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্রীড়াবাজির সাইট বেট ৩৬৫ ডটকম। এছাড়া অনলাইনে জুয়া খেলার জনপ্রিয় সাইটগুলোর মধ্যে বেট এশিয়া ৩৬৫, বেটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, সাইট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম ও পেডি পাওয়ার ডটকম বাংলাদেশে প্রচলিত।

জানা গেছে, অনলাইনে জুয়া খেলতে প্রথমে যেকোনো অনুমোদিত ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে হয়। সেই একাউন্টের রেফারেন্সে ক্রেডিট কার্ড নেয়া হয়। এ ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা ট্রান্সফার করতে হয় ডলারের মাধ্যমে। এ অনলাইন জুয়ার একাউন্ট সবার থাকে না। হাতেগোনা কয়েকজনের থাকে। তাদেরই একজন কক্সবাজারের মোস্তফা। কয়েকজন একাউন্ট হোল্ডারের আবার একাধিক ব্রোকার বা দালাল থাকে। তাদের সহায়তায় অনলাইন জুয়ার একাউন্টধারী ব্যক্তির রেফারেন্সে যাদের একাউন্ট নেই এ রকম হাজার হাজার জুয়াড়ি অনলাইন জুয়ায় অংশ নেয়। দালালরা বাজিকরদের কাছ থেকে বাজি ধরার জন্য নগদ টাকা নিয়ে বাজিতে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়। প্রতিটি খেলায় বাজির উপাত্ত দেওয়া থাকে। তার ওপর ভিত্তি করেই বাজি ধরে থাকে জুয়াড়িরা। অনলাইন জুয়াড়ি মোস্তফার সিন্ডিকেটের লেনদেন নিয়ন্ত্রণ হতো কক্সবাজার আর দুবাইয়ে। কক্সবাজারের জুয়াড়িদের ডলার বিক্রি করতেন তিনি। অর্থ্যাৎ অনলাইন কেন্দ্রিক জুয়ায় ডলার ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণে ছিল মোস্তফার।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চলমান থাকবে। এটা নিয়ে গভীরভাবে কাজ চলছে। এই নেটওয়ার্কের আওতায় যারা থাকবে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

আরও খবর