বাংলা ট্রিবিউন :
নিত্য নতুন কৌশলে মানবপাচারের চেষ্টা চালাচ্ছে অপরাধীরা। সীমান্ত পথে বা সাগর পথে তো আছেই এমনকি আকাশ পথেও নিত্য নতুন পরিচয়ে চলছে মানবপাচার। এরমধ্যে সংগীতশিল্পী, কবি, সমাজকর্মী, উন্নয়নকর্মী পরিচয়গুলোর পাশে এখন সাংবাদিক পরিচয়েও টুরিস্ট ভিসায় চলছে মানবপাচার। মূলত দেশের বিমানবন্দর পার করে দিতেই ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতেই পাচারের শিকার ব্যক্তিদের এমন পরিচয় দেওয়ার কথা বলে প্রলুব্ধ করে পাচারকারীরা। যদিও সংবাদপত্রের সঙ্গে ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা কখনোই থাকে না। আর এ কাজে কিছু ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে ‘আন্ডারগ্রাউন্ডের’ কিছু পত্রিকার সাংবাদিকও জড়িত। বিমানবন্দর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ৮ অক্টোবর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিক পরিচয়ে ইস্তানবুল হয়ে গ্রিসে পাচারের সময় দুজনকে আটক করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সদস্যরা। আটক দুজনের নাম মো. দুলাল খান ও মো. শাহাদাত হোসেন। তাদের কাছে পাওয়া যায় ‘দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি’ নামের একটি সংবাদপত্রের পরিচয়পত্র। বিমানবন্দরে গোয়েন্দা নজরদারি এড়াতে মূলধারার বাইরের এই পত্রিকাটির সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে গিয়েই উল্টো গোয়েন্দাদের নজরে পড়ে তারা।
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন বলেন, নানা কৌশলে মানবপাচার হয়ে থাকে। পাচারকারীরা নানা সময়ে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে। দেখা গেছে, কখনও সংগীতশিল্পী, কখনও কবি, সাংবাদিকসহ নানা পরিচয়ে পাচারের কৌশল নেয় পাচারকারীরা। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, ভ্রমণসহ নানা কারণ দেখিয়ে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে বিদেশে যায়। আর ফিরে আসে না।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, ৮ অক্টোবর মো. দুলাল খান ও মো. শাহাদাত হোসেনকে ডিপারচার চেক ইন কাউন্টার থেকে আটক করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থা। পরবর্তীতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আইন শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। জিজ্ঞাসাবাদে তারা দুজন স্বীকার করেন, ভিজিট ভিসায় তারা বাংলাদেশ থেকে ইস্তানবুল যাচ্ছেন, পরে সেখান থেকে গ্রিসে যাবেন। দুজনেরই গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। জিজ্ঞাসাবাদে মো. শাহদাত হোসেন জানান, গ্রিসে যাওয়ার জন্য আ. রহিম নামের এক দালালের সঙ্গে ১০ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছে তার। প্রথমে দালাল রহিমকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দেন তিনি। এরপর আবার সাড়ে তিন লাখ টাকা দালাল রহিমকে দেন শাহাদাত। তখন দালাল রহিম তাকে এমএম ওহি ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস এর মালিক ওসমানের কাছে নিয়ে যান। ওসমান তাকে নয়া পল্টনে দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি পত্রিকার নয়া পল্টনের ৮৫/১ ভবনের ৫ম তলার অফিসে নিয়ে যান।
শাহাদাতের বর্ণনা অনুযায়ী, পত্রিকাটির সম্পাদক এমজি কিবরিয়া চৌধুরী তাকে দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি পত্রিকার অফিস অ্যাসিন্ট্যান্ট এর আইডি কার্ড ও ভিজিটিং কার্ড বানিয়ে দেয়।
অন্যদিকে, জিজ্ঞাসাবাদে দুলাল খান জানান, গ্রিসে পাঠানোর জন্য তার সঙ্গে এমএম ওহি ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস এর মালিক ওসমানের সঙ্গে সাত লাখ টাকার চুক্তি হয়। প্রথম ধাপে তিনি এক লাখ টাকা ওসমানকে দেন। দুলাল খানকেও নিয়ে যাওয়া হয় দৈনিক জাতীয় অর্থনীতির পত্রিকা অফিসে। পত্রিকাটির সম্পাদক কিবরিয়া তাকেও বানিয়ে দেন সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টারের আইডি কার্ড ও ভিজিটিং কার্ড। বিমানবন্দরে প্রবেশের পর আইডি কার্ড গলায় ঝুলানোর কথা দুলাল ও শাহাদাত দুজনকেই শিখিয়ে দেন সম্পাদক কিবরিয়া চৌধুরী। বিমানবন্দরে দুজনকে কোথাও কোনও প্রশ্ন করলেই সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার কথাও বলে দেওয়া হয়। তাদের দুজনকে আশ্বস্ত করা হয় কোনও সমস্যা হলে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের সিনিয়র এএসপি সাখাওয়াত হোসেন সহায়তা করবেন। তাদের কাছে বিমানবন্দরের ডিউটি এএসপির ফোন নম্বরও দিয়ে দেওয়া হয় যোগাযোগের জন্য। দুলাল ও শাহাদাত বিমানবন্দরের আসার পর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ডিউটি এসএসপির ফোন নম্বরে কল করলে, তাদের এয়ারলাইন্সের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করতে বলা হয়। এরপর দুজন কাতার এয়ারওয়েজের কাউন্টারে বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করতে যান। ওই কাউন্টার থেকেই তাদের দুজনকে আটক করেন এনএসআই সদস্যরা।
সূত্র জানায়, আটক করার পর দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাদের ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের বোর্ডিং কার্ড বাতিল করার জন্য কাতার এয়ারওয়েজকে নির্দেশ দেয়। আটক দুজনকে পরবর্তীতে বিমানবন্দর থানায় হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে তাদের জবানবন্দি নিয়ে নির্দোষ বিবেচনা করে ছেড়ে দেয় বিমানবন্দর থানা পুলিশ।
বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরে আজম বলেন, বিমানবন্দর থেকে দুলাল ও শাহাদাত নামের দুজনকে থানায় পাঠানো হয়। কিন্তু আমরা অনুসন্ধান করে জানতে পারি তারা মূলত ভুক্তভোগী। এ কারণে তাদের আইনি পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ভুক্তভোগী মো. দুলাল খান বলেন, এমএম ওহি ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক ওসমান আমাদের পূর্ব পরিচিত, তার মাধ্যমে আমি ইস্তানবুল যাওয়ার জন্য টাকা দেই। আমাদের তিন মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা ছিল। সেখানে গেলে কোনও চাকরি খুঁজে আবার ভিসার জন্য আবেদন করবো এমন কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিল এমএম ওহি ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের ওসমান ।
পত্রিকার আইডি কার্ড প্রসঙ্গে মো. দুলাল খান বলেন, আমি কখনও ওই পত্রিকা অফিসে কাজ করিনি। তবে বিমানবন্দরে যাতে কোনও ঝামেলা না হয় এজন্য কিবরিয়া চৌধুরী আইডি কার্ড বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারপর আমরা বিদেশ যেতে পারিনি।
এ প্রসঙ্গে দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি’র সম্পাদক এমজি কিবরিয়া চৌধুরী বলেন, আমার পত্রিকার বয়স ২০-২২ বছর। সারা দেশে আমাদের পত্রিকার কার্ড (আইডি কার্ড) আছে। কোনটা কাকে দিয়েছি, আমি কিভাবে বলবো? সাংবাদিকতা ছাড়া আমার আর কোনও পেশা নেই। তিনি দাবি করে বলেন, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই। কেউ যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে তবে তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যেই তা করেছে।
বিমানবন্দরে আটক হওয়া দুলাল ও শাহাদাতকে চেনেন না বলেও দাবি করেন এমজি কিবরিয়া চৌধুরী।
এ বিষয়ে জানতে এমএম ওহি ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক ওসমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-