রোহিঙ্গাদের ভুয়া এনআইডিতে ৩০ কোটি টাকার বাণিজ্য

ডেস্ক রিপোর্ট • রোহিঙ্গাদের ভোটার করা ও ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়ার মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের জালিয়াত চক্র ৩০ কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য করেছে বলে ধারণা করছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা।

তারা বলেছেন, প্রতিটি এনআইডির জন্য ৭০ থেকে ২ লাখ টাকা নিয়েছে জালিয়াত চক্র। আবার কারও কাছে ২ লাখের বেশিও টাকাও নেওয়া হয়েছে। একটি এনআইডি তৈরি করতে চার থেকে পাঁচ স্তরে টাকা ব্যয় করতে হয়েছে রোহিঙ্গাদের। এর বাইরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো। সেই হিসাবে ২ হাজারের বেশি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতে প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। রোহিঙ্গাদের ভুয়া এনআইডি তৈরির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের কথা শিকার করেছেন ডবলমুরিং নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন। এনআইডি তৈরির মধ্যস্থতা করে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন জয়নাল। শুধু জয়নাল অন্তত ১৮০০ রোহিঙ্গার ভুয়া পরিচয়পত্র সরবরাহ করেছেন। জয়নাল গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীর পৌর সদরের আশকরিয়া পাড়ায় প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া তার নামে-বেনামে কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই নির্বাচন কর্মকর্তাসহ জড়িত সাতজনের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, অন্তত দেড় বছর ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের একটি জালিয়াত চক্র দুই সহস্রাধিক লোকের ‘ভুয়া পরিচয়পত্র’ বানাতে কাজ করে আসছে।

কিছু অসাধু ‘কর্মচারী, টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটরের’ সহায়তায় এই চক্র এনআইডি দেওয়ার জন্য লোক বাছাই থেকে শুরু করে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ করছে। রোহিঙ্গা ভোটার করতে চার-পাঁচ ধাপে টাকা লেনদেন হতো। প্রথমে কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রামে নেওয়া হতো। এ জন্য ৩০ হাজার টাকা লাগত। পরে চট্টগ্রাম থেকে সংশ্লিষ্ট অফিসে নিতে লাগত ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ভুয়া মা-বাবা ভাড়া নিতেও টাকা লাগত। আবার কার্ড প্রিন্টের জন্য আলাদা একটা টাকা দিতে হতো। দালালরা এই টাকার ভাগ দিতেন কয়েক স্তরে। সেই ভাগ ঢাকা অফিস পর্যন্ত আসত বলে তথ্য পেয়েছেন ইসির কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে একটি এনআইডি তৈরি করতে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা খরচ হতো। এনআইডি উইংয়ের বিশেষ কারিগরি কমিটির সদস্য বলছেন, ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ‘ভুয়া’ এনআইডি দেওয়ার ভ্রাম্যমাণ অফিস খুলে বসেছিল এ চক্র।

৭০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে সুচতুরভাবে পুরনো সফটওয়্যারের মতো করে ২০১৬ সালের ইস্যু করা আদলে এনআইডি বানিয়ে দালালের হাতে তুলে দিত তারা। এ কাজে ইসির হারানো ল্যাপটপ ব্যবহারের সন্ধান মিলেছে। এনআইডি উইংয়ের কর্মকর্তারা জানান, জালিয়াত চক্রে সম্পৃক্ত এনআইডি প্রকল্পের সাপোর্ট স্টাফ সাগরকে অনিয়মের জন্য ২০১২ সালে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে ২০১৫ সালে কারও সুপারিশে তিনি আবার যোগ দেন। সত্য সুন্দর নামে আরেক ব্যক্তি ঢাকার একটি উপজেলা নির্বাচন অফিসে কাজ করেন। তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। নানা কারণে চাকরি খোয়ানো কিছু স্টাফ পরিচিতি ও গোপনীয়তা ব্যবহার করে জালিয়াত চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

এদিকে এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কোনো ছাড় দিচ্ছি না। আমরা খুব কঠোর অবস্থানে আছি। কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারী, প্রকল্পের লোক- যে-ই সম্পৃক্ত থাকুক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ফাঁদ পেতে একটি চক্রকে ধরতে সক্ষম হই। সামরিক বাহিনীতে আমরা যেটাকে অ্যামবুশ বলি। এর মাধ্যমে আমাদের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের কর্মচারী জয়নালকে প্রথমে চিহ্নিত করা হয়। এরপর অন্যদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সংখ্যাটা ১৫ জনের বেশি হবে না। যারা এই অপচেষ্টার সঙ্গে জড়িত তাদের বেশির ভাগ ইসি থেকে এর আগে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় নানা অপরাধের কারণে ইসি থেকে চাকরিচ্যুত যারা হয়েছেন, তাদের তালিকা করে সেই তালিকা আমরা বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। ইসির কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিয়েছি, যাতে কোনোভাবেই অস্থায়ী ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ দেওয়া না হয়। ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটর হিসেবেও যাতে তারা নিয়োগ না পান তারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চাকরিচ্যুতদের আমরা কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখছি।’ মহাপরিচালক বলেন, ‘ইতিমধ্যে বিষয়টি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা কোনোভাবেই ভোটার তালিকা হালনাগাদ বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করতে না পারেন।’

৩০ চাকরিচ্যুত নজরদারিতে : চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি এবং চাকরিচ্যুত ৩০ প্রকল্পকর্মীকে মাঠপর্যায়ে কোনো কাজে সম্পৃক্ত না কার জন্য বলেছে আইডিইএ প্রকল্প। তাদের কর্মকান্ড নজরদারিতে রাখছে ইসি। এর মধ্যে রয়েছেন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মুন্সী সানজিদ বিন একলিম স্বাধীন, এস এম রকিবুজ্জামান নিয়ন, খান মো. ওবাইদুল্লাহ, মো. আবদুল্লাহ-আল-মারুফ, মোহাম্মদ সাদেক হোসাইন, মোহাম্মদ জাকির হোসাইন, মো. ইয়াসির আরাফাত ও মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম; টেকনিক্যাল সাপোর্ট মো. ইকবাল হোসাইন, মির্জা আসিফ ইবনে আশরাফ; ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটর মো. আবু বক্কর সিদ্দিক, মারজিয়া আক্তার লিজা, শেখ সেলিম শান্ত, মো. সোলায়মান, মো. জামাল উদ্দিন, মো. সাবেদুল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, মো. জাকির হোসেন, মো. বাবুল আহমেদ, মো. আবদুল জলিল মিয়া, মো. ইকবাল হোসেন, রবিউল করিম, সুব্রত কুমার বিশ্বাস, সুমন দেব, ইউসুফ আলী চৌধুরী, ইকবাল আহমেদ, মো. তারিক আজিজ, মো. মোস্তফা ফারুক, সুতপা রানী এবং ম্যাসেঞ্জার মো. আশিকুল ইসলাম। একই সঙ্গে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তা ও ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটরদের বিষয়ে মূল্যায়নসহ কোনো অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের আলাদা আলাদা চিঠি দেওয়া হয়েছে। আইডিইএ প্রকল্পের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান খান এ-সংক্রান্ত দুটি চিঠি মাঠপর্যায়ে পাঠিয়েছেন।

আরও খবর