রফিক উদ্দিন বাবুল • উখিয়া :
মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্যাম্পে সেদেশের সীম ব্যবহার করছে। টেকনাফ-উখিয়ার সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এ নেটওয়ার্ক সুবিধা গ্রহণের প্রতি ঝুঁকছে বেশি। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প কেন্দ্রিক অপরাধ দমনে সরকার উখিয়া-টেকনাফে মোবাইল নেটওয়ার্ক সীমিত রাখায় মারাত্মক নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ে রয়েছেন স্থানীয়রা। ফলে ক্যাম্পে ও ক্যাম্পের আশপাশে ইন্টারনেট ব্যবহার ও মুঠোফোনে কথা বলতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ৪ লক্ষাধিক মোবাইল গ্রাহককে। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু কিছু জায়গায় মোটেও মোবাইলে যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা। এ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মী, প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় নিয়োজিত কর্মজীবিরা বেকায়দায় পড়েছেন। স্থানীয়রা এসব দূর্ভোগের আবর্তে থাকলেও রোহিঙ্গারা নাছোড়বান্দা। তারা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ওপার থেকে মিয়ানমারের মোবাইল সীম সরবরাহ এনে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে আশ্রিত জীবনে আসার পর থেকে কৌশলে বাংলাদেশী সিম সংগ্রহ করে কথা ও ইন্টারনেট যোগাযোগ রেখে আসছেন রোহিঙ্গারা। কিন্তু ২৫ আগস্টের মহাসমাবেশের পর থেকে উখিয়া-টেকনাফে মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। ফলে স্থানীয়দের মতো রোহিঙ্গারাও মুঠোফোনে আগেরমতো যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ফলে বিকল্প হিসেবে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকছেন রোহিঙ্গারা। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের সীম সংগ্রহ এবং মিয়ানমারে অবস্থানরত বিভিন্ন আত্মীয়দের মাধ্যমে মোবাইলে রিচার্জ করছে এসব সিম ব্যবহারকারিরা। মুঠোফোনের ডিসপ্লেতে ইংরেজিতে ‘এমপিটি’ লেখা দেখা গেছে। ০৯৮৯১৬৮৮.., ০৯২৬৩১৭৯৬.., ০৯৪০৯৩২০৪.. এভাবে এসব সীমেও এগার ডিজিট সংখ্যা রয়েছে।
সিম ব্যবহারকারি রোহিঙ্গারা জানান, টেকনাফের জাদিমুড়া, হ্নীলা, নয়াপাড়া, মুচনী এসব ক্যাম্প নাফনদীর কিনারায় হওয়ায় মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সী ভালই পাওয়া যায়। বাংলাদেশী নেটওয়ার্কের চেয়েও বেশি কার্যকর সেবা দেয় এ নেটওয়ার্ক।
অপরদিকে, উখিয়ার ক্যাম্পগুলো নাফনদী থেকে একটু দূরে হলেও বালুখালী, পালংখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পগুলোর সড়কের কাছাকাছি এলাকায় মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সী ভালই মিলছে। ভেতরের ক্যাম্পগুলোতে এ সুবিধা পাওয়া কষ্টকর।
কুতুপালংয়ের সালামত খান নামে এক রোহিঙ্গা জানান, আমরা আরাকানে থাকাকালীন বাংলাদেশী সিম ব্যবহার করতাম। এপারের পরিচিত অনেকে তখন রিচার্জ করে দিতেন। মোবাইলে অভ্যস্ত রোহিঙ্গারা এখন মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করে নেট দুনিয়ার সাথে রয়েছি। ওপারে থাকা রোহিঙ্গারা বা মধ্যপ্রাচ্য থেকেও স্বজনরা রিজার্জ করে দেয় অনেককে।
ক্যাম্প এলাকায় কোথায় রিচার্জ হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাদিমুড়া ও হ্নীলায় এবং বালুখালীতে কয়েকটি দোকানে মিয়ানমারের সীম ও রিচার্জ পাওয়া যেত কিন্তু বাংলাদেশী প্রশাসনের সতর্ক দৃষ্টির পর এখন দোকানে এসব বিক্রি হয় না। কৌশলে হাতে হাতে বিক্রি চলছে এখন। বিশেষ করে টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের সীমসহ তিন রোহিঙ্গা আটকের পর খুবই সন্তর্পনে চলছে মিয়ানমারের সিম বিক্রি।
স্থানীয় আইটি বিশেষজ্ঞরা জানায়, সীমান্তের টেকনাফ পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উখিয়া সীমান্ত দিয়ে অবশ্য এটি দেখা যায় কম। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে নদী ছাড়া গাছগাছালি কম হওয়ায় নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সী বেশি মিলছে। আর উখিয়া সীমান্তে গাছ-গাছালি বেশি হওয়ায় এখানে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক কাজ করে কম।
জানা যায়, বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয় পত্র ও ফিঙ্গার দিয়ে একজন গ্রাহক ১৫টি সীম উত্তোলন করতে পারেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এনআইডি না থাকলেও হাতে হাতে কয়েক লাখ সীম ব্যবহার করতো। নামে-বেনামে ব্যবহার করা সীমে বিদেশে তথ্য সরবরাহের পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধমুলক কর্মকান্ড চালিয়েছে রোহিঙ্গারা।
সম্প্রতি টেকনাফে যুবলীগ নেতা ওমর হত্যা ও উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের মহা-সমাবেশসহ বেশ কয়েকটি ঘটনায় ব্যাপক আলোচনায় চলে আসে রোহিঙ্গারা। মহাসমাবেশে বিভিন্ন দাবী দাওয়ার ঘটনা ও একই রকমের টি-শার্ট, বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন, প্লে-কার্ড কিভাবে পেলো তা নিয়ে রীতিমতো হৈচৈ শুরু হয়। এঘটনায় ক্যাম্পে কর্মরত কতিপয় এনজিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে এবং তাদের কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শুধু তাই নয়, গত ২২ আাগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষন থাকলেও রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে রাজি না হওয়ায় একজনকেও প্রত্যাবাসন করা যায়নি। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে স্বশস্ত্র উগ্রপন্থি সংগঠন হোয়াটসআপ, ইমু, মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ চ্যাট করে প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচারণা ও সাধারন রোহিঙ্গাদের হুমকী দেয় বলে অভিযোগ উঠে।
ফলে সরকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে থ্রি-জি ও ফোর-জি ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক সীমিত রাখার ঘোষনা দেয়। এর প্রেক্ষিতে গত পক্ষকাল সপ্তাহ ধরে নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনায় পড়ে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক নির্ভর হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। ফলে মিয়ানমার থেকে সীম এনে ব্যবহার করছে তারা। সরকারের সীদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করে ইন্টারনেট ও মুঠোফোন ব্যবহার অব্যহত রেখেছে রোহিঙ্গা। ক্যাম্পের ভেতর মোবাইল জব্দের কোন অভিযান না হওয়ায় এমনটি হচ্ছে বলে ধারণা স্থানীয়দের।
শালবাগান ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ২০০ টাকায় সীম সংগ্রহ করেছি। মিয়ানমারে থাকা আত্মীয়রা মোবাইল রিচার্জ করে দেন।
এদিকে, চাহিদার কারণে মিয়ানমার থেকে সেদেশিয় সিম আনছে একটি চক্র। এদেরই তিনজনকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৫ টার দিকে টেকনাফ স্থল বন্দরের প্রধান গেইট এলাকা থেকে আনসারের সহযোগিতায় পুলিশ আটক করে। তাদের তল্লাশি চালিয়ে ২২২ টি মিয়ানমারের ‘এমপিটি’ নামে সিম উদ্ধার করা হয়। তারা বন্দরে আসা মিয়ানমারের ট্রলারে করে এসব সিম উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিচ্ছিল।
আটকরা হলো, ট্রলার মাঝি মিয়ানমার মংডু বিচিডিল এলাকার নুরুল আলমের ছেলে নুর হাসান (২২), টেকনাফের নয়াপাড়া মুচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হোসনের ছেলে সলিম (২৬) ও উখিয়া জামতলী রোহিঙ্গা শিবিরের মেহের শরীফের ছেলে রবি আলম(২২)।
টেকনাফ মডেল থানার ওসির প্রদীপ কুমার দাশ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, মিয়ানমারের সিমসহ আটক তিন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাকিদের ধরতে চেষ্টা চলছে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও সাবেক সাংসদ অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী বলেন, নেটওয়ার্ক সীমিতের ভুক্তভোগী আমিও।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) আবুল মনছুর জানান, রোহিঙ্গাদের মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সী নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এতে স্থানীয়রা ভোগান্তি পেলেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের সীম ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখন মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ আসছে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আইন অমান্য করলে মানবিকতার পাশাপাশি তাদের উপর কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-