রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ: গ্রেপ্তার হবেন জড়িত জনপ্রতিনিধিরা

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এএফ কবির আহমেদ মানিক গত ১৭ জুলাই এক রোহিঙ্গার নামে জন্মসনদ ইস্যু করেন। সনদটি জমা দিয়ে মোহাম্মদ ফয়সাল নামের ওই রোহিঙ্গা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে আঙুলের ছাপ নিতে গিয়ে দেখা গেল, ফয়সাল বাংলাদেশের নাগরিক নয়। বরং রোহিঙ্গা ডাটাবেসে তার আঙুলের ছাপ রয়েছে। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে জানানো হলে ফয়সালকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এএফ কবির আহমেদ মানিক কিছু বলতে অসম্মতি জানান। যদিও ইতিপূর্বে তিনি দাবি করেছিলেন, প্রযুক্তির সহায়তায় এ সনদ তৈরি করা হয়েছে। এটি তিনি দেননি।

রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে এএফ কবির আহমেদ মানিকের মতো চসিকের একাধিক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নাম যেমন এসেছে, তেমনি বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের নামের তালিকাও তৈরি করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক আমাদের সময়কে বলেন, কিছু কিছু জনপ্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ দেওয়ার দুষ্টচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে আমরা ইতিমধ্যে পুলিশকে বলে দিয়েছি। জড়িতদের গ্রেপ্তারের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, আমরা দেখব জনপ্রতিনিধিরা জ্ঞাতসারে এ কাজ করেছেন কিনা। যদি করে থাকেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে সহায়তাকারী জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পাসপোর্ট অফিস ও নির্বাচন কমিশন থেকে সংগ্রহ করা সন্দেহজনক ১৩৮টি ফরমের জন্মনিবন্ধন সনদের বিষয়ে যাচাই-বাচাই করছে দুদক। এসব সনদে যেসব জনপ্রতিনিধির স্বাক্ষর আছে তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর চলছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিকেও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এই তদন্ত কাজের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিশনের প্রধান কার্যালয় থেকে অধিকতর তদন্তের অনুমতিপত্র পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের জিজ্ঞাসাবাদও শুরু করা হবে।

দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এ উপপরিচালক মাহবুবুল আলম বলেন, প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে আমাদের একটি এনফোর্সমেন্ট দল রোহিঙ্গাদের ভোটার জালিয়াতির বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। আমরা ইতোমধ্যে অনেক জনপ্রতিনিধিকে রোহিঙ্গা ভোটার জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত করেছি। মূলত দুদকের অনুসন্ধানের পরই নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের টনক নড়েছে। দুদক তদন্ত দল ইতোমধ্যে নগরীর মনসুরাবাদ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ও পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে জমা দেওয়া ফরমের মধ্য থেকে রোহিঙ্গা সন্দেহে ৫৪টি, কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিস থেকে ২০টি ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস থেকে পাওয়া ৭২টিসহ মোট ১৩৮টি ফরমে জন্মনিবন্ধন সনদ ও অন্যান্য তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সন্দেহে দুদক যেসব জন্মসনদ পরীক্ষা করছে তাতে চসিকের ওয়ার্ড কাউন্সিলর এএফ কবির আহমেদ মানিক, শৈবাল দাস সুমন, আশরাফুল আলম, ইয়াসিন চৌধুরী, হাটহাজারী, কক্সবাজার জেলার রামু, বাঁশখালী, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ উপজেলার একাধিক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর আছে। দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের চুরি যাওয়া ল্যাপটপ থেকে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি চসিকের ঠিকানায় স্মার্টকার্ড তৈরি করে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার নূর মোহাম্মদ। স্মার্ট কার্ডে তার বাবার নাম ছিল কালা মিয়া এবং মা সরু বেগম। স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া হয়েছে পশ্চিম ষোলশহর পার্ট-২, হিলভিউ রোড, ৪২১১ পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম। তদন্তে দেখা গেছে, যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে তা ভুয়া। এই এনআইডির বিপরীতে সিটি করপোরেশনের ৭ নং ষোলশহর ওয়ার্ড অফিসের যে জন্মনিবন্ধন সনদ ব্যবহার করা হয়েছে সেটিও জাল।

দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, অনুসন্ধান শুরুর পর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচনী কার্যালয়ের একাধিক ব্যক্তি আত্মগোপন করেছেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে অফিস সহকারী জয়নাল আবেদীনসহ ৩ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এর বাইরে দুদক কর্মকর্তারা আরও কিছু লোকের খোঁজ পেয়েছেন। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া এই লোকেরাও বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন ঢাকার শাহ নূর, তার ভাগ্নে মো. শহিদুল্লাহ ও ভাগনি শারমিন আক্তার, চাচাতো ভাই মো. শাহেদ, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর শাহ আলম, কক্সবাজারের রামু এলাকার মোহাম্মদ হিরু, পাঁচলাইশ এলাকার তাসলিম আক্তার, ডবলমুরিং এলাকার শাহ জামাল, বাঁশখালী নির্বাচন অফিসের অপারেটর শাহেদ হোসেন, কক্সবাজারের নঈম ইসলাম। তারা ছাড়াও চট্টগ্রাম ও ঢাকার নির্বাচন অফিসের একাধিক নির্বাচন কর্মকর্তা এ কাজে যুক্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে।

সূত্র : আমাদের সময়

আরও খবর