রোহিঙ্গা ভোটার একটি ল্যাপটপেই যত রহস্য!

এমজমিন •

নির্বাচন কমিশনের ভোটার এন্ট্রি করা ১৫৫৭-৪৩৯১ কোডের ল্যাপটপটি হারিয়েছে ২০১৫ সালে। ল্যাপটপটি ৪ বছর আগে হারিয়ে গেলেও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেনি চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিস। এমনকি হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপটি উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। কিন্তু ওই ল্যাপটপ দিয়েই প্রায় দুই হাজারের অধিক রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে বলে সন্দেহ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। ওই ল্যাপটপ দিয়েই নির্বাচন অফিসের কিছু কর্মচারী সিন্ডিকেট রোহিঙ্গাদের ভোটার করে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।

এমনটাই বলছেন, দুদক চট্টগ্রাম জেলা-২ সমন্বিত কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট টিমের লিডার সহকারী পরিচালক রতন কুমার বিশ্বাস। শুধু তাই নয়, ওই একটি ল্যাপটপেই যত রহস্য লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন দুদক কর্মকর্তারা। তবে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে নির্বাচন কার্যালয়ের ডবলমুরিং থানার সহায়ক জয়নাল আবেদীনসহ ৫ জনকে আটক ও একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। সেই ল্যাপটপটি এই ল্যাপটপ কিনা তাও নিশ্চিত নয় দুদক বা নির্বাচন কমিশন।

দুদক কর্মকর্তারা মনে করছেন, ২০১৫ সালে হারিয়ে যাওয়া ৪৩৯১ কোডের ল্যাপটপ দিয়েই রোহিঙ্গা ভোটার করার অপকর্মগুলো হয়েছে। ওই ল্যাপটপের হদিস মিললে অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে। কিন্তু নির্বাচন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, এটিই সেই ল্যাপটপ। যার কোড বদলে ফেলায় দুদক বা নির্বাচন কমিশনের কেউ এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না। কিন্তু ল্যাপটপের তথ্য যাচাই করা হলে বেরিয়ে আসবে আসল রহস্য।       

নির্বাচন কার্যালয়ের সূত্রমতে, পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদ ওরফে নুর আলম, লাকি আক্তারের মতো অসংখ্য রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে। তাদের ভোটার এন্ট্রি হয়েছিল এ ল্যাপটপ দিয়েই। ওই ল্যাপটপ দিয়ে বেশ কয়েকটি থানার ভোটারও করা হয়েছে।

দুদক সূত্রমতে, ভোটার হওয়ার জন্য কমপক্ষে থানা পর্যায়ের কর্মকর্তা ভোটার এন্ট্রি করার কথা। নির্বাচন অফিসের লোকজন জড়িত না থাকলে এত বড় অপকর্ম হওয়ার সুযোগ নেই। এখন প্রাথমিক অনসুন্ধান চলছে। নির্বাচন অফিস থেকে আমরা কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। অধিকতর অনুসন্ধানের অনুমতির জন্য আমরা কমিশনে প্রতিবেদন দেব।

দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দিন জানান, ল্যাপটপটি হারিয়ে গেছে বললেও সেটির জন্য থানায় সাধারণ ডায়েরি কিংবা উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি নির্বাচন অফিস। আমরা সন্দেহ করছি ওই ল্যাপটপটি দিয়ে দুই থেকে আড়াই হাজারের কাছাকাছি রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে। ওই ল্যাপটপ দিয়ে মোস্তফা আলী নামের একমাত্র বাঙালি ভোটার হয়েছেন। তার বাড়ি বাঁশখালীতে। মোস্তফা আলীর এক আত্মীয় চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসে চাকরি করেন।

রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার নেপথ্যের অনুসন্ধানে গত রোববার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসে অভিযান চালিয়েছে চার সদস্যের দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম। অভিযানে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন দুদক এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার পেছনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার নির্বাচন অফিসের বেশ কয়েকজন কর্মচারী জড়িত। ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে একেকজন রোহিঙ্গাকে ভোটার করা হয়েছে। নজিবুল নামের এক দালালের মাধ্যমে কক্সবাজার নির্বাচন অফিসের এক অফিস সহায়ক ভোটার হতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসে চক্রের অন্য সদস্যদের কাছে পাঠান। চট্টগ্রাম অফিসের ডবলমুরিং থানার অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন রোহিঙ্গাদের ভোটার করার পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারী ওই অফিস সহায়কের পেছনে ৫ জন অস্থায়ী কর্মচারীও কাজ করে।

চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান বলেন, ল্যাপটপ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো ২০১৫ সালের। তখন আমরা দায়িত্বে ছিলাম না। চন্দনাইশ ও পাঁচলাইশের কয়েকটি ল্যাপটপ হারিয়েছে। চন্দনাইশে হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপের বিষয়ে থানায় জিডি করা হয়েছিল।

পাঁচলাইশের ল্যাপটপ হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জেনেছি পরে। এখন রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসায় নির্বাচন কমিশন থেকে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে যাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলবে তাদের বিরুদ্ধে কমিশন নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে।

প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে কয়েকটি ল্যাপটপ মিরসরাই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওইখানে হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপটিও ছিল। ওইসব ল্যাপটপ বহন করেছিল মোস্তফা ফারুক নামের আমাদের অস্থায়ী একজন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট।

কিন্তু মোস্তফা ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মিরসরাইয়ে যে ল্যাপটপ নেয়া হয়েছিল তার অফিস আদেশ সংরক্ষিত রয়েছে। ওই সময় ৪৩৯১ কোডের ওই ল্যাপটপটি সেখানে ছিল না। তাছাড়া সাবেক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের গঠিত কমিটি বিষয়টি তদন্ত করছেন। মোস্তফা ফারুক জানান, রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার পেছনে কারা জড়িত, জেলা অফিসের সবাই জানে। কেউ ভয়ে মুখ খুলছে না।   
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের গঠিত তদন্ত দলের প্রধান খোরশেদ আলম তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার পরই নির্বাচন কমিশন থেকে বিষয়টি গণমাধ্যমে জানানো হবে।

আরও খবর