ভুয়া পরিচয়ে রোহিঙ্গার স্থায়ী নিবাস যেভাবে চট্টগ্রাম!

চট্টগ্রাম প্রতিদিন:

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার জামালপাড়া। পাড়ায় প্রবেশ করতেই প্রথম বাড়িটি তিনতলা ভবন। মালিক হারুন সরদার। ওই ভবনে প্রায় সাত বছর ধরে বসবাস করছেন মিয়ানমার থেকে আসা রহমত উল্যাহর পরিবার। রহমত উল্যাহ বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে পাড়ি জমিয়েছেন মালয়েশিয়া। তার চার সন্তানকে নিয়ে স্থানীয় পরিচয়ে বসবাস করছেন তার স্ত্রী সাজেদা। বড় মেয়ে কওসার ও মেজ মেয়ে আজিদা বিবি পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে, সেজ মেয়ে ইসমত আরা সপ্তম শ্রেণিতে আর সবার ছোট সুমাইয়া পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। সবার আছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম নিবন্ধন সনদও।

এভাবে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে এসে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় মানুষের সাথে মিশে যাচ্ছে। অনেকের কাছেই আছে জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও স্মার্টকার্ড। জায়গা কিনে বিল্ডিং করেও বসবাস করছে অনেক রোহিঙ্গা। অর্থের বিনিময়ে এদের সহায়তা দিচ্ছে রাজনৈতিক নেতা, সরকারি অনেক কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।

আরমাস খাতুন তার মেয়ে রমজান বিবিকে নিয়ে বসবাস করছেন কর্ণফুলী উপজেলার জামালপাড়ার আরেকটি পাকা ঘরে। দুইবার গিয়েও তার ঘরের দরজা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন তার দুই ছেলে ফয়েজ ও শফিউল মালয়েশিয়া গিয়েছেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে। তার আরেক ছেলে সিরাজ প্রায় ১০ বছর বাবুর্চির কাজ করছেন হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ক্যান্টিনে। ক্যান্টিনে গিয়ে বাবুর্চি সিরাজকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘ভাইয়ারা মাঝে মধ্যে টাকা পয়সা পাঠান। এক বোনের বিয়ে দিয়েছি বাঁশখালীতে।’

ষাটোর্ধ মো. ইউনুছ। তার ৩ ছেলের বড়জন ওসমান পিকআপ চালক। অপর দুই জন কবুতর-ইঁদুরের খাঁচা তৈরি করেন। ইউনুছের পেশাও ছিল একই। তারা জায়গা কিনে বিল্ডিংও তৈরি করেছেন জামালপাড়ায়। ইউনুছের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই জায়গা আমার বাপের আমল থেকে আমাদের। নিজেদের জায়গায় ঘর তৈরি করেছি।’
তিনি জানালেন, ১৯৬৩ সালে তারা মিয়ানমার থেকে এসে এখানে বসবাস করছেন।

হারুন সরদারের বড় ভাই রহিম উদ্দিনের কাঁচা কলোনিতে থাকেন জাফর আহমেদ। জাফর ফিশারিঘাট থেকে মাছ কিনে ভ্যানে করে গ্রামে বিক্রি করেন। তার বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আরেক রোহিঙ্গা যুবকের সাথে। মেয়ে এবং মেয়ের জামাই সৌদি আরবে থাকেন। জাফরের বেয়াইরা থাকেন কক্সবাজারের উখিয়ায়। মেয়ে আর মেয়ের স্বামীর সাথে যোগাযোগ আছে জাফরের পরিবারের। টাকা পয়সাও পাঠান সৌদি আরব থেকে। জাফরের ছেলেরা এলাকায় কামলার কাজ করেন। মেয়ে তসলিমা পড়ে স্থানীয় এসএ চৌধুরী স্কুলে।

পাশের ঘরে থাকেন আইয়ুব। ষাটোর্ধ লোকটি ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালান। তার দুই সংসার—প্রথম সংসারে চার মেয়ে এক ছেলে। ছেলে লোকাল বাসের হেলপার। এক মেয়ে স্বামীসহ সৌদি আরবে থাকেন। রাশেদা নামে আরেক রোহিঙ্গা নারীকে বিয়ে করে হারুনের ভাই রহিমের কাঁচা কলোনিতে থাকছেন। রাশেদার সংসারে এক ছেলে এক মেয়ে। যৌবনে আইয়ুব তার পরিশ্রম দিয়ে এলাকার মানুষের সহানুভূতি পেয়েছেন। একাই একাধিক শ্রমিকের সমান কাজ করে দিতেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো আইয়ুবের নামে ইস্যু হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রও।

এলাকাবাসী জানিয়েছেন আইয়ুবসহ কয়েকজন রোহিঙ্গার বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র তাদের কাছে থাকে না। এটি জমা রেখেছেন কর্ণফুলী আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এসএম সাঈদের কাছে। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে এসএম সাঈদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জামালপাড়ায় রোহিঙ্গারা এসেছে প্রায় ৩০ বছর আগে। তারা এলাকার স্থানীয় মানুষের সাথে মিশে যাচ্ছে। অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্রও তৈরি করেছেন। আমি বারবার প্রতিবাদ করেছি। আমার ব্যাপারে যে অভিযোগ তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।’

স্থানীয় শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক বানানো হয়েছে। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর কাউকে জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। আমার পরিষদের সকল সদস্য এবং কর্মকর্তারাও সতর্ক আছে। আগে যারা এসে এলাকায় স্থায়ী বসতি গড়েছেন তাদের ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা বাস্তবায়নে আমরা তৈরি আছি।’

এসএ চৌধুরী কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘এই এলাকায় বাসা ভাড়া দেওয়ার সময় সরকারি নিয়মে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেখা হয় না। যে যার মতো ঘর ভাড়া দেয়। এলাকায় অনেকে আত্মীয়-স্বজন করে ওদের সেটেল্ড করেছেন। তাদের সংখ্যা ধারণার চেয়ে অনেক বেশি।’

এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পের বাইরে থাকতে না পারে সেজন্য আমরা সতর্ক আছি। ইতোমধ্যে যাদের পেয়েছি আমরা ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছি।’ তবে দীর্ঘদিন বসবাসের কারণে স্থানীয়দের সাথে মিশে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোন তথ্য নেই বলে জানান তিনি। তবে তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানালেন তিনি।

কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা আবদুস শুক্কুর জানান, ‘উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে সকল নিয়মকানুন মেনে ৬ হাজার ২০ জন স্মার্ট কার্ডের আবেদন করেছিলেন। ছবি তোলার সময় আমি সশরীরে উপস্থিত থেকে ৭২ জন রোহিঙ্গা চিহ্নিত করেছি। তবে যারা আগে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেছেন তাদের ব্যাপারে স্থানীয়দের কেউ নির্বাচন কমিশন কিংবা আদালতে অভিযোগ করলে তখন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।’

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সর্বপ্রথম রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে বাংলাদেশে। এরপর অনিয়মিতভাবে নানা সময়ে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা ১৯৯২ সাল এবং ২০০৩ সালে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের মুখে আরাকান থেকে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। তবে রোহিঙ্গাদের বিশাল একটা অংশ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে।

আরও খবর