সায়ীদ আলমগীর, জাগো নিউজ •
রোহিঙ্গা নেতার কন্যার কান ফোঁড়ানো অনুষ্ঠানে অতিথিদের কেউ এনেছেন স্বর্ণালংকার, কেউ এনেছেন রুপা। নগদ টাকা উপহার দিয়েছেন অনেকেই।
সম্প্রতি টেকনাফের দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদের কন্যার কান ফোঁড়ানো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা এভাবে উপহার নিয়ে আসেন। এ অনুষ্ঠানে এক কেজি স্বর্ণালংকার ও নগদ ৪৫ লাখ টাকাসহ আরও নানা উপহার পাওয়া যায়।
দীর্ঘদিন বাংলাদেশে বসবাস করে কোটিপতি বনে গেছেন রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদ। তার কন্যার কান ফোঁড়ানোর রাজকীয় উৎসব ঘিরে গত এক সপ্তাহ ধরে আলোচনায় ছিলেন তিনি। পাশাপাশি টেকনাফের ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক হত্যা মামলায় তার সম্পৃক্ততার কথা উঠে আসায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন নুর মোহাম্মদ।
সেই নুর মোহাম্মদ রোববার ভোরে টেকনাফের জাদিমোড়া এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। যুবলীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে গ্রেফতারের পর অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার সঙ্গীদের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনায় নুর মোহাম্মদ নিহত হন বলে দাবি করেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। ঘটনাস্থল থেকে চারটি এলজি, একটি থ্রি-কোয়াটার, ১৮ রাউন্ড গুলি, ২০ রাউন্ড খালি খোসা উদ্ধার করা হয়েছে বলেও দাবি ওসির।
নিহতের মধ্য দিয়ে নুর মোহাম্মদের চ্যাপ্টার শেষ হতে পারতো। কিন্তু মরে গিয়েও চমকপ্রদ আলোচনার পথ রেখে গেছেন রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার নুর মোহাম্মদ। তার মরদেহের সঙ্গে পাওয়া ‘বাংলাদেশি স্মার্টকার্ড’ এ আলোচনাকে সরব করেছে। চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকার বাসিন্দা হিসেবে নুর আলম নামে বাংলাদেশের ভোটার হয়েছেন এবং যথারীতি স্মার্টকার্ডও সংগ্রহ করেছেন আলোচিত ডাকাত নুর মোহাম্মদ।
নুর মোহাম্মদের বাংলাদেশি স্মার্টকার্ডটি ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের ঠিকানায় ইস্যু করা হয়। কার্ডে তার নাম নুর আলম। বাবা কালা মিয়া এবং মা সরু বেগম। জন্মতারিখ ২৫ নভেম্বর ১৯৮৩। জন্মস্থান চট্টগ্রাম। এনআইডি নম্বর-৬০০৪৫৮৯৯৬৩।
স্থায়ী ঠিকানায় লেখা আছে, বাসা/হোল্ডিং- মাস্টারের মার বাড়ি, গ্রাম/রাস্তা-বার্মা কলোনি, হিলভিউ রোড, পশ্চিম ষোলশহর (পার্ট-২), ডাকঘর- আমিন জুট মিলস-৪২১১, পাচঁলাইশ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের আকিয়াব এলাকা থেকে বাংলাদেশে ঢুকে রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদ হ্নীলা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের জাদিমুরা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। পরে জমি কিনে বাড়ির মালিক হন। গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারে টেকনাফের প্রতিটি ক্যাম্পে বিয়ে ও ঘর করেন নুর মোহাম্মদ। প্রতিটি ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ কর্মকাণ্ড তার ইশারায় হতো। নুর মোহাম্মদের মালিকানায় একটি দোতলা, একটি পাকা ভবন, একটি টিনের ঘর এবং একটি বাগানবাড়িসহ চারটি বাড়ি রয়েছে। নুর মোহাম্মদের রয়েছে একাধিক স্ত্রী।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের আগমনের শুরু থেকেই কক্সবাজারে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শরণার্থী হিসেবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আগে রোহিঙ্গারা যাতে এদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র না পায় সেজন্য মূলত এ সিদ্ধান্ত নেয়া। এ কার্যক্রম চালু থাকায় কক্সবাজার জেলার বাসিন্দারা জন্মনিবন্ধনসহ নানা সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মানবিকতার খাতিরে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গা ও নুর মোহাম্মদের মতো চিহ্নিত অপরাধীরা কীভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো এবং স্মার্টকার্ড পেলো। নুর মোহাম্মদ হয়তো তার সঙ্গীদেরও স্মার্টকার্ডের আওতায় এনেছেন।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, এভাবে যদি রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্টকার্ড বা পাসপোর্ট পেতে থাকে তাহলে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। দীর্ঘমেয়াদে এর খেসারত বাংলাদেশকেই দিতে হবে। রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদ ও সঙ্গীরা রোহিঙ্গাদের খাবার দিয়ে সহযোগিতা করা হ্নীলার যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সরকারদলীয় নেতারা যেখানে রোহিঙ্গাদের নির্মমতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না, সেখানে স্থানীয় সাধারণ মানুষ তো তো আরও অসহায়। তাই রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে এবং স্মার্টকার্ড পেতে সহযোগিতাকারীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা দরকার।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা অপরাধীদের বাংলাদেশি স্মার্টকার্ড পাওয়া চরম দুঃখজনক। লোভের বসে কিছু অসাধু ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে এবং পাসপোর্ট পেতে সহযোগিতা করে। এটা যে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার চেয়ে ক্ষতিকর তা বোঝে না লোভী মানুষগুলো।
তিনি বলেন, সহযোগিতাকারীদের মধ্যে যারা ধরা পড়ে তারা শাস্তির মুখোমুখি হয়। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের আরও সচেতন হওয়া দরকার। পাশাপাশি দরকার এ অপরাধ নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ। আমরা সেই পথে হাঁটছি।
প্রসঙ্গত, শনিবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের উলুচামরী পাহাড়ি এলাকা থেকে কুখ্যাত রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার নুর মোহাম্মদ সহযোগীসহ গ্রেফতার হন। তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি গোপন রেখে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযানে যায় পুলিশ। সেখানেই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন নুর মোহাম্মদ।
গত ২২ আগস্ট রাতে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে (৩০) গুলি করে হত্যা করা হয়। একদল রোহিঙ্গা ফারুককে বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে পাশের একটি পাহাড়ে তুলে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা টায়ার এবং প্লাস্টিকের বক্স জ্বালিয়ে টেকনাফ পৌরসভা থেকে লেদা পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সড়ক তিন ঘণ্টা অবরোধ করে। রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদের বাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
২৩ আগস্ট রাতে জাদিমোড়া পাহাড়ের পাদদেশে ওমর ফারুক হত্যাকাণ্ডে জড়িত জাদিমোড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. শাহ ও আবদুর শুক্কুর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ২৬ আগস্ট একইভাবে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন আরেক অভিযুক্ত মো. হাসান। সর্বশেষ রোববার ভোরে নিহত হন প্রধান অভিযুক্ত ডাকাত সর্দার নুর মোহাম্মদ।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-