রোহিঙ্গা নেতাদের অনেকে কোটি টাকার মালিক বনে গেছে

এইচএম এরশাদ, জনকণ্ঠ

মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের নাগরিক রোহিঙ্গা। ওই জাতিগোষ্ঠী যে কোন অজুহাতে একবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বা আশ্রয় গ্রহণ করতে পারলেই হলো। ওপারে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, অবৈধ কারবার ও প্রবাসে থাকা রোহিঙ্গাদের পরামর্শে বিদেশী অর্থ এনে সহজে ধনী বনে যায় দেশে। ইতোমধ্যে পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের কেউ কেউ বড় বড় দালানের মালিক বনে গেছে। আবার কেউ প্রসিদ্ধ দোকানি, কোটি কোটি টাকার সম্পদসহ বিত্তশালী বনে স্থায়ী হয়ে পড়েছে এদেশে। এসব দেখে পরবর্তীতে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা সহজে ফিরতে চাইছে না মিয়ানমারে।

সূত্র জানায়, বিএনপি জিয়াউর রহমানের আমলে (১৯৭৮) প্রায় সাড়ে ৪ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছিল উখিয়া টেকনাফে। ওই সময় প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়ে যায় এদেশে। তখন বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে ভিটাবাড়ি কিনে নিজেদের নামে দলিল সৃষ্টি করেছে। ওসব জমির দলিল ও বিএনপি-জামায়াত নেতা এবং শিবির ক্যাডারদের মদদে রোহিঙ্গারা অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে ভোটার তালিকায়। ১৯৭৮সালে অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা মীর কাশেম আলী রামু রাবেতা আল-আলম ইসলামী হাসপাতালে বসে গঠন করে দেন বিদ্রোহী সংগঠন আরএসও।

সূত্র জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করা প্রভাবশালী রোহিঙ্গা ও কয়েক পাকিস্তানী নাগরিকের (জঙ্গী) পরামর্শে রোহিঙ্গাদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। বিদেশী নাগরিকদের নিয়ে গঠিত ওই সন্ত্রাসী কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন যুদ্ধাপরাধী (মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া) মীর কাশেম আলী। এ সুযোগে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের দোহাই তুলে বিদেশ থেকে অর্থ এনে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান মীর কাশেম আলী। বিএনপি সরকারের পটপরিবর্তনের পর মীর কাশেমের পরামর্শে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশী ভুয়া ঠিাকানায় পাসপোর্ট বানিয়ে পাড়ি জমায় পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। ওই রোহিঙ্গারা সেখানে অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি বিদেশীদের কাছ থেকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। অন্তত ৯টি বছর ধরে তিনি গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করেন বিদেশে থাকা ওই রোহিঙ্গা জঙ্গীদের সঙ্গে। পরবর্তী আরএসও ভেঙ্গে এআরইউ, এআরএনও সহ একাধিক রোহিঙ্গা সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে প্রত্যাবাসনের স্বার্থে দেশের বিভিন্নস্থানে ঘাপটি মেরে থাকা ওসব জঙ্গীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি (খালেদা জিয়া) আমলে (১৯৯১) আরএসও ক্যাডারদের পাঠিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত বরাবর ওপারে তুমব্রু ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারে নিরাপত্তা ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে দেশটির প্রশাসনকে উস্কানি দিলে পরবর্তীতে বর্মী সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার শুরু করবে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসবে বাংলাদেশে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তখন তাদের আশ্রয় হবে বাংলাদেশে। ওসব রোহিঙ্গার অসহায়ত্বের দোহাই তুলে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ আনা সম্ভব হবে বিদেশ থেকে। আরএসওর ওই সিদ্ধান্তে ক্যাডাররা মিয়ানমারের লুণ্ঠিন (সীমান্তরক্ষী) ঘাঁটিতে ২৮ নবেম্বর হামলে পড়ার পর ঠিকই ১৯৯১সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। এরপর সংগঠিত করা হয় আরএসও ক্যাডারদের।

এদিকে জামায়াত নেতা মীর কাশেম তাদের হাতে প্রশিক্ষণের নামে অস্ত্র তুলে দিয়ে উখিয়া, টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি, রামু ও চকরিয়ার বিভিন্ন পাহাড়ে ঘাঁটি তৈরির ব্যবস্থা করে দেন। গোপন আঁতাত থাকায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ওই সময় অস্ত্রসহ একজন রোহিঙ্গা জঙ্গীকেও গ্রেফতার করেনি। অথচ ওই সময় আরও একাধিক রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রুপের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ১৯৯৬সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর দেশে জঙ্গী নির্মূলে নামে। সরকারের নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় আরএসও জঙ্গীদের ওসব আস্তানা। উদ্ধার করা হয়েছিল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ। এর পর থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে রোহিঙ্গা জঙ্গী আরএসও ক্যাডাররা।

সূত্র আরও জানায়, উখিয়ার বালুখালীতে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গী সংগঠন আলইয়াকিন ক্যাডারদের ঘন ঘন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। ২বছর আগে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী ভয়ঙ্কর রোহিঙ্গা জঙ্গীরা অংশগ্রহণ করে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে। উগ্র ওই জঙ্গী সংগঠনের জন্য রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদাও আদায় করা হচ্ছে। এ কাজে যারা বিরোধিতা করবে, বৈঠকে তাদের তুলে নিয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গী সংগঠন আল-ইয়াকিনের অন্তত ৩১ প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা কিলার বিভিন্ন আশ্রয় ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা জানায়, কেউ প্রত্যাবাসনে রাজি হয়েছে জানলে ইতোপূর্বে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানেও আলইয়াকিন জঙ্গী সংগঠনের নেতা কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা জাবের, আব্দুল হাকিম, ইউনুচ, নুর কামাল, নুরুল ইসলাম, নুর বশর, শামশুল আলমসহ কয়েকজন সন্ত্রাসী অস্ত্র ঠেকিয়ে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের অপহরণ করে গভীর অরণ্যে নিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রাণের ভয়ে কেউ স্বদেশে ফিরে যাবে বলে মুখ খুলে বলার সাহস পাচ্ছে না।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারী সংস্থা সূত্রে জানা যায়, ক্যাম্পের বাইরে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে বসবাসকারী পুরনো রোহিঙ্গাদের আইনের আওতায় আনা না হলে প্রত্যাবাসন কাজ সহজ হবে না। কেননা রোহিঙ্গা সমস্যাটি জিইয়ে রাখতে পুরনো আরএসও জঙ্গীরা এবং কয়েকটি এনজিও খুবই তৎপর। তাদের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটছে দেখে তারা প্রত্যাবাসনে ষড়যন্ত্র করে উস্কানি দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালী ও টেকনাফের কেরুনতলী, পুঠিবনিয়া ও নয়াপাড়া রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার স্থানীয় কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, রোহিঙ্গারা যে ২২আগস্ট মিয়ানমারে ফিরে যাচ্ছে সে অনুভূতি তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। রোহিঙ্গারা প্রশ্ন করে জানায়, মিয়ানমার সরকার এখনও আমাদের দাবি পূরণ করে নেয়নি, আমরা কেন আগ্রহী হয়ে ফেরত যাব?

আরও খবর