মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস আজ

‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩৭৮ জন নিহত তবুও ভাঙেনি সিন্ডিকেট; দাপট কমেনি বড় কারবারিদের

সাহাদাত হোসেন পরশ ও বকুল আহমেদ

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করেছিল র‌্যাব। এর পর পৃথকভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালায় পুলিশও। এ অভিযানে পুলিশ-র‌্যাব ও বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৩৭৮ জন। গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এ অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৫৮৫ জন। এর পাশাপাশি চলতি বছরই টেকনাফের ১০২ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করে পুলিশের কাছে। মাদকবিরোধী অভিযানে প্রায় ৪০০ নিহত ও ১০২ জনের আত্মসমর্পণের পরও থেমে নেই ইয়াবার কারবার। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এলো- অভিযানে বড় কারবারিদের অধিকাংশের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করা যায়নি। একেবারেই ভাঙা যায়নি মাদক ব্যবসা ঘিরে গড়ে ওঠা অবৈধ অর্থনৈতিক সিন্ডিকেট। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার কারবার প্রায় পুরোপুরি হুন্ডিনির্ভর। 

যারা ইয়াবার কারবারের নেপথ্যে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ করছে, তারা এখনও রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। রুট পাল্টিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইয়াবা পৌঁছে দিচ্ছে তারা। এমনকি ইয়াবা কারবারে সংশ্নিষ্ট যারা এরই মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের আস্তানায়ও মিলছে মাদক। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, কারাগারে বসেই কি মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা? 

কয়েক বছর ধরে মাদক সমাজের জন্য এক সর্বগ্রাসী সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ২০১৮ সালে একাধিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এর পরই নড়েচড়ে বসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 

কক্সবাজারের র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিজ আহমেদ বলেন, ‘অভিনব কৌশল ব্যবহার করে ইয়াবা কারবারিদের অনেকে এখনও সক্রিয় রয়েছে। মিয়ানমার থেকে যেসব রুট হয়ে ইয়াবা আসে, সবগুলোতে নজরদারি জোরদার করা হচ্ছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে যারা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।’ 

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘মাদকের বড় কারবারিদের নতুন একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের সম্পদের উৎস যাচাই-বাছাইয়ে সংশ্নিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। শুধু টেকনাফ থানায় দুই হাজারের বেশি মাদক মামলার ওয়ারেন্ট রয়েছে। এসব আসামির সবাই পলাতক।’ 

জানা গেছে, কক্সবাজার জেলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা এক হাজার ১৫১। তালিকার বাইরে আরও কয়েকশ’ ইয়াবা কারবারি রয়েছে। তাদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল’ আছে। তারাই মূলত নেপথ্যে মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। আর মাদক চক্রের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য রয়েছে। এই দুষ্টু চক্রের বৃত্ত ভাঙা না গেলে মাদকবিরোধী অভিযানের সুফল মেলা কঠিন। 

চলতি বছরে অস্ত্র, ইয়াবাসহ আত্মসমর্পণ করে ১০২ কারবারি। তারা এখন কক্সবাজারের কারাগারে রয়েছে। আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে গডফাদার ৩০ জন। এখনও অর্ধশত গডফাদার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরই মধ্যে টেকনাফে মাদক কারবারিদের মধ্যে কয়েকজনের বাড়ি ও সম্পদ ক্রোক করা হয়। গত বছর দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুধু কক্সবাজারেই ৬০ জন নিহত হয়। 

রুট বদল :স্থানীয় ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার দেশে প্রবেশের সবচেয়ে সহজ রুট হলো নাফ নদ। এখনও অধিকাংশ ইয়াবা এ রুটে আসছে। তবে নাফ নদ ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করায় অনেকে রুট বদলে ফেলেছে। এখন সমুদ্রপথে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে দেশে ঢুকছে ইয়াবা। আবার কিছু চালান মিয়ানমার হয়ে সমুদ্রপথে সরাসরি চট্টগ্রাম চলে যায়। অনেক কারবারি মিয়ানমার থেকে সিলেট সীমান্তের মাধ্যমে দেশে আনছে। কেউ কেউ আবার গভীর সমুদ্রপথে নিয়ে যাচ্ছে পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলায়। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেকে সমুদ্র ও নদীপথে ঢাকার সদরঘাট পর্যন্ত ইয়াবা নিয়ে আসে। 

হুন্ডির মাধ্যমে বিনিয়োগ :খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার এ কারবার প্রায় পুরোপুরি হন্ডিনির্ভর। যে ব্যক্তি মূলত নেপথ্যে বসে ইয়াবার কারবারে বিনিয়োগ করে, সে সরাসরি মিয়ানমারের পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। হুন্ডির মাধ্যমে ইয়াবা বিক্রির অর্থ সৌদি আরব বা দুবাই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে তা চলে যায় সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকে তা চলে যায় মিয়ানমারের পার্টির কাছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এখন পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানে যারা গ্রেফতার বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে তাদের অধিকাংশ ইয়াবার চালানের বাহক বা ক্ষুদ্র বিক্রেতা। এ কারবারে নেপথ্যে যারা অর্থ বিনিয়োগ করে আসছে, তাদের খুব বেশি ধরা যায়নি। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে এমন অনেকের খোঁজ পাওয়া গেছে, যারা বাহ্যিকভাবে অন্যান্য ব্যবসায় জড়িত হলেও নেপথ্যে তারা ইয়াবার কারবারে অর্থ লগ্নিকারী। তাই বন্ধ হয়নি ইয়াবার স্রোত। 

আত্মসমর্পণকারীর আস্তানায়ও ইয়াবা :স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২ মে কক্সবাজারের তারাবনিয়াছড়া এলাকায় শীর্ষ ইয়াবা কারবারি আবু তাহেরের বাসায় অভিযান চালিয়ে ৬০ হাজার পিস ইয়াবাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। যদিও এরই মধ্যে সে আত্মসমর্পণ করে কক্সবাজারের কারাগারে রয়েছে। জেলখানায় বসেও তাহের তার ভাই আবু বকর ও হাছান মুরাদের মাধ্যমে ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। এখনও টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ, শাহজাহান মিয়া, ইলিয়াছ মিয়া, মৌলভি রফিক উদ্দিন, মৌলভি আজিজ উদ্দিন, জাফর আলমসহ অনেকে নানা কৌশলে কারবার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। 

দিনে ৩৩৫ মামলা : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মাদকসংক্রান্ত মামলা করেছে এক লাখ ৫০ হাজার ৭৮৮টি। আসামি সংখ্যা দুই লাখ এক হাজার ২৮১ জন। গড় হিসাবে প্রতিদিন মামলা হয়েছে ৩৩৫টি।

মাঠপর্যায়ে দৃশ্যপট একই :ইয়াবা সেবন করে এমন অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠপর্যায়ে ইয়াবার চাহিদা কমেনি। বরং ইয়াবাসেবীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সরবরাহ রয়েছে আগের মতই। বেচাকেনা ও বহনে নতুন কৌশল গ্রহণ করছে কারবারি ও বাহকরা। নানাভাবেই ইয়াবা ক্রেতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। 

দিবসের কর্মসূচি :আজ ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো- ‘সুস্বাস্থ্যই সুবিচার, মাদকমুক্তির অঙ্গীকার।’ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা দিবসটি ঘিরে গ্রহণ করেছে নানা কর্মসূচি। আজ সকাল ৮টায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে মানববন্ধন ও মাদকবিরোধী ভ্রাম্যমাণ প্রচার কার্যক্রমের আয়োজন করেছে। সকাল সাড়ে ১০টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট কমপ্লেক্সে আলোচনা সভা ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণ করার কথা রয়েছে বিজয়ীদের হাতে।

/সমকাল

আরও খবর