আজিম নিহাদ :
তারা তিনজনই এক সময় সৌদি আরবে ছিলেন। প্রবাসে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে সুসম্পর্ক তৈরী হয়। কয়েক বছর আগে নিজেদের মধ্যে ‘সন্ধি’ (চুক্তি) করে দেশে ফিরেন। তাদেরও আগে থেকে দেশে আসা একজনের সাথে সিন্ডিকেট করে শুরু করেন ইয়াবা কারবার। এই সিন্ডিকেটের ইয়াবা দেশের গ-ি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পর্যন্ত নির্বিঘেœ পৌছেছে।
তিনজনের এই সিন্ডিকেটের একজন প্রাণে বাঁচলেও বাকি দু’জন শনিবার রাতে র্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। নিহতরা হলেন- শহরের আইবিপি রোড়ের পাইকারী দোকান (মুদিরদোকান) ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম লিটন ও হ্নীলার লেদা গ্রামের দীল মোহাম্মদ। আর প্রাণে বেঁচে যাওয়া ইয়াবা ব্যবসায়ী হলেন- হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা গ্রামের রবিউল আলম। পৃথক অভিযানে তাদের কাছ থেকে তিন লক্ষাধিক ইয়াবাও উদ্ধার করেছে র্যাব।
তারা শুধু তিনজন নয়; র্যাব বলছে, এই ইয়াবা সিন্ডিকেটে আরও অনেক কথিত প্রবাসী জড়িত রয়েছেন। এরমধ্যে শহরের আইবিপি রোড ও বড়বাজার এলাকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীও আছেন। তাদেরকে গ্রেপ্তারেও অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে দাবী র্যাবের।
র্যাব সূত্র জানায়, গত ১৪ জুন দুপুরে কক্সবাজার শহরের উত্তর তারাবনিয়ারছড়া শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউটের পাশের একটি বাড়ি থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার পিচ ইয়াবাসহ শীর্ষ ব্যবসায়ী রবিউল আলমকে তার সহযোগীসহ আটক করা হয়। ওই সময় আরেক ইয়াবা ব্যবসায়ী দিল মোহাম্মদ ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে আটক রবিউল আলমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী শহরের বাজারঘাটা আইবিপি রোডের নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাই ভাই স্টোর (মুদিরদোকান) থেকে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে শহিদুল ইসলাম লিটনকে আটক করা হয়। পরে শহিদুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার রাতে র্যাব তাকে নিয়ে টেকনাফের শামলাপুর এলাকায় ইয়াবা উদ্ধারের অভিযানে যায়। এসময় ওৎপেতে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে র্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়।
এতে প্রাণ হারান ইয়াবা ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম লিটন (৪২), হ্নীলার লেদা এলাকার গবি সোলতানের ছেলে দিল মোহাম্মদ (৪২) ও নাইক্ষ্যংছড়ির রাশেদুল ইসলাম সৌরভ। সৌরভ নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবা, ৪টি দেশে তৈরী অস্ত্র, ১২ রাউন্ড তাজা গুলি, ১৬ রাউন্ড গুলির খোসা, নগদ ৫ হাজার ২৮০ টাকা ও সীম সংযুক্ত তিনটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১৫ এর সিইও উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘নিহত শহিদুল ইসলাম লিটন ও দিল মোহাম্মদ এবং রবিউল আলম (বর্তমানে কারাগারে) সৌদি আরবে ছিলেন। তারা সৌদি আরব ভিত্তিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সদস্য। তাদের সিন্ডিকেটের আরও অনেক প্রবাসী এবং বর্তমানে প্রবাস থেকে দেশে ফেরা লোকজন জড়িত আছেন। বিশেষ করে রবিউল এবং শহিদুলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, শহরের বাজারঘাটা এলাকায় অনেক পাইকারি ব্যবসায়ী বা দোকানদার এই মাদক ব্যবসায়ী চক্রের সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে জড়িত রয়েছে। এই চক্রটি বিশাল। চক্রের প্রত্যেক সদস্যকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
নিহতদের মধ্যে শহিদুল ইসলাম লিটন আইবিপি রোডের একজন সৎ ও শান্ত প্রকৃতির ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তার নিজ বাড়ি চট্টগ্রামের আমিরাবাদ মাস্টার হাট গ্রামে। তার বাবা আবুল কাশেম দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার শহরে আইবিপি রোডে পাইকারী দোকানের ব্যবসা করে আসছেন। বাবার সাথে শহিদুল ইসলাম লিটনও আইবিপি রোডে ব্যবসা চালাতেন। এক সময় শহিদুল সৌদি আরব চলে যান। সেখানে বেশ কয়েক বছর প্রবাস যাপন করেন। প্রায় ৪/৫ বছর আগে দেশে চলে আসেন। আবার শুরু করেন আইবিপি রোডের দোকানের ব্যবসা। তাদের দোকানের নাম ভাই ভাই স্টোর। শহিদুল ইসলামের পুরো পরিবার থাকেন পেশকারপাড়া ভাড়া বাসায়।
হঠাৎ শহিদুল ইসলামের ক্রসফায়ারের খবরে ‘হতচকিত’ হয়ে পড়েন শহরের আইবিপি রোড় ও বড়বাজারের দোকান ব্যবসায়ীরা। তারা দাবী করেন, শহিদুল কোন অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন না। তবে মাঝেমধ্যে তার দোকানে হুন্ডির টাকা লেনদেন হতো বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী দাবী করেন।
সূত্রমতে, সৌদি আরবে থাকাকালীন সময়ে টেকনাফের হ্নীলা এলাকার শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী আবু তাহেরের (আত্মসমর্পন করে কারাগারে আছেন) সাথে সিন্ডিকেট করেন নিহত আইবিপি রোডের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম, হ্নীলার লেদা এলাকার দিল মোহাম্মদ ও রবিউল আলম। পরে প্রথমে দেশে চলে আসেন ইয়াবা ব্যবসায়ী আবু তাহের। এরপর একে একে চারজনই দেশে ফিরেন। সবাই কক্সবাজার শহরে বাড়ি তৈরী করে অথবা ভাড়া বাসায় অবস্থান নিয়ে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেন। আবু তাহের তারাবনিয়ারছড়ায়, দিল মোহাম্মদ বিজিবি ক্যাম্প চৌধুরীপাড়ায়, রবিউল আলম উত্তর তারাবনিয়ারছড়া ও শহিদুল ইসলাম আইবিপি রোডে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন।
ইয়াবার চালান পাচারকারীদের মাধ্যমে আনা-নেওয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন আবু তাহের, দিল মোহাম্মদ, রবিউল আলম ও আবু তাহেরের ভাই আবু বক্কর। আর প্রতিটি চালানের সঙ্গে থাকতেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক সৌরভ। এছাড়াও সৌরভ নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত কেন্দ্রীক তাদের সিন্ডিকেটের ইয়াবা পাচার নিয়ন্ত্রণ করতেন।
পুরো সিন্ডিকেটের ইয়াবার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন করতেন আইবিপি রোডের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম লিটন। তাদের ইয়াবা বিক্রির টাকা সৌদি আরব থেকে এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসতো শহিদুল ইসলাম লিটনের কাছে। তার কাছ থেকে চক্রের অন্যান্য সদস্যরা টাকা সংগ্রহ করতেন। র্যাবের অনুসন্ধানেও এ তথ্য-ই উঠে এসেছে।
আইবিপি রোডের কয়েকজন ব্যবসায়ী এবং দোকানের কর্মচারী জানান, শহিদুল ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন কিনা না সেটি তারা কেউই জানেন না। তিনি একজন ভাল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। তার দোকানে প্রায়ই হুন্ডির টাকা লেনদেন হতো।
নিহত শহিদুলের ছোট ভাই রিপন রোববার সকাল ১০ টার দিকে আইবিপি রোডে দোকানের সামনে দাবী করেন, তার ভাইকে (শহিদুল) শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় দোকান খোলার সময় দুইজন সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি এসে নিয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে কোথাও খবর পাওয়া যায়নি। পরে শনিবার গভীর রাতে শোনা যায় টেকনাফে র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন।
তিনি দাবী করেন, জীবনে কোনদিন খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেননা তার ভাই। সৎভাবে দোকানের ব্যবসা চালাতেন। একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল তার। তার ভাইকে অন্যায়ভাবে খুন করা হয়েছে। তিনি এই অন্যায়ের বিচার আল্লাহ’র কাছে দিয়েছেন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-