অনলাইন ডেস্ক – চট্টগ্রামের সিনিয়র জেলার কারাবন্দি সোহেল রানা বিশ্বাসকে মোটা অঙ্কের টাকা, এফডিআরের চেক ও মাদকসহ গ্রেফতারের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে কারাগারের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স পার্থ গোপাল বণিক, জ্যেষ্ঠ সুপার প্রশান্ত কুমার, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী, জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসসহ ৪৮ জনকে দায়ী করা হয়েছে।
এছাড়া দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও বদলির সুপারিশ করা হয়েছে। সে সুপারিশ অনুযায়ী ওই ঘটনায় দায়ী ডিআইজি প্রিজন্স চট্টগ্রাম বিভাগ পার্থ গোপাল বণিকসহ কারা কর্মকর্তা ও অফিসারদের মধ্যে ১৯ জনকে বদলি করা হয়েছে। তা ছাড়া নিম্নতম অফিসার ও কারারক্ষীসহ বাকিদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে বলে কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।
অপরদিকে এ কারাসেক্টরে ভয়াবহ দুর্নীতির মামলার তদন্তে গিয়ে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৩ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন।দুদক সূত্র বলেছে, তদন্ত স্বচ্ছতা রাখার জন্যই তদন্ত অফিসার আইও পরিবর্তন করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত কয়েকদিন আগে এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন ময়মনসিংহ দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক সাধনচন্দ্র সূত্রধর। এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন দুদকের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং পরে দায়িত্ব দেয়া হয় দুদকের উপ-পরিচালক ফারুক আহমেদকে।
এদিকে জব্দ করা ২৬টি ব্যাংক হিসাবে ১৫ কোটি টাকা লেনদেনের সন্ধান পেয়েছে দুদক। তবে সঠিক হিসাব পেতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে দুদকের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১২টি ব্যাংকের হিসাববিবরণী তদন্তকারী কর্মকর্তার হাতে পৌঁছেছে বলে জানান মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, জেলার সোহেল রানা, তার স্ত্রী-সন্তান ও শ্যালকের নামের ব্যাংক হিসাব জানতে দুদকের কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিলে ২৬টি ব্যাংক হিসাবের তালিকা পাঠায়। তারপর কিশোরগঞ্জ আদালতের অনুমতিক্রমে ওই হিসাবগুলোর লেনদেন জব্দ করে দুদক।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবহেলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাখিলকৃত প্রতিবেদনে যাদেরকে দায়ী করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন এই কারাগারের তৎকালীন ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী, জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস, ডেপুটি জেলার মুহাম্মদ মুনীর হোসাইন, মো. ফখর উদ্দিন, মো. আতিকুর রহমান, মুহাম্মদ আবদুস সেলিম, হুমায়ন কবির হাওলাদার, মনজুরুল ইসলাম, সৈয়দ জাবেদ হোসেন, সহকারী সার্জন ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ফার্মাসিস্ট রুহুল আমিন, রামেন্দু মজুমদার পাল, কর্মচারী লায়েস মাজহারুল হক।
কারারক্ষী ও অন্যান্য কর্মচারীর মধ্যে রয়েছেন মো. আবুল খায়ের, নূর আলম, গাজী আবদুল মান্নান, মো. তাজউদ্দিন আহমেদ, আবদুর করিম, মোসলেম উদ্দিন, বেলাল হোসেন, হিসাবরক্ষক এমদাদুল ইসলাম, ক্যান্টিন ম্যানেজার অলিউল্লাহ, এইচ এম শুভন, কাউছার মিয়া, আরিফ হোসেন, আনোয়ার হোসেন, মিতু চাকমা, শহিদুল মাওলা, শরিফ হোসেন, জুয়েল রানা, আনোয়ার হোসেন, স্বপন মিয়া, মহসিন দপাদার, আনজু মিয়া, লোকমান হাকিম, শিবারন চাকমা, ত্রিভূষণ দেওয়ান, অংচহ্না মারমা, রুহুল আমিন, শাহাদাত হোসেন, শাকিল মিয়া, আবদুল হামিদ, ইকবাল হোসেন, শামীম শাহ, মো. উসমান, মো. বিল্লাল হোসেন ও অডিট টিমের সদস্য আবু বকর সিদ্দিকী। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া ও কম গুরুত্বপূর্ণ জেলায় বদলির সুপারিশ করেছে কমিটি।
গত বছরের ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, আড়াই কোটি টাকার ব্যাংক এফডিআর, এক কোটি ৩০ লাখ টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের চেক ও ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ ভৈরব রেলওয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ওই দিন চট্টগ্রাম থেকে আন্তঃনগর বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনে ময়মনসিংহে নিজ বাড়ি যাওয়ার পথে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন বিরতির সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। এ সময় টাকার উৎস জানাতে না পারায় তার বিরুদ্ধে ভৈরব রেলওয়ে থানায় পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করে। এরপর মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলাটি রেলওয়ে পুলিশ তদন্ত করে ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ আদালতে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়।
অপরদিকে, মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের করা মামলাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ময়মনসিংহ দুদকে তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। গত আট মাস ধরে মামলাটির তদন্ত চলছে। ঘটনার পরপর সোহেলকে কর্তৃপক্ষ সাময়িক বরখাস্ত করে এবং ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তার কাছ থেকে জব্দ করা ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা কিশোরগঞ্জের সরকারি ট্রেজারিতে জমা দিয়েছে রেলওয়ে পুলিশ।
দুদক সূত্র বলেছে, জেলার সোহের রানা গ্রেফতারের দুইদিন পরই জব্দ আড়াই কোটি টাকার এফডিআরের মধ্যে এক কোটি টাকা তার শ্যালক ও স্ত্রী ময়মনসিংহের দুটি ব্যাংক থেকে প্রতারণার মাধ্যমে উত্তোলন করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ময়মনসিংহ দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক সাধনচন্দ্র সূত্রধর বলেন, জেলার সোহেল রানা, তার স্ত্রী-সন্তান ও শ্যালকের ২৬টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে আরও ৪৮ জনের জড়িতের বিষয়ে তিনি বলেন, মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি মাত্র কয়েকদিন হলো। মামলাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষীর বক্তব্য নিতে হচ্ছে। তাই মামলাটির চার্জশিট আদালতে জমা দিতে আরও দুই মাস সময় লাগতে পারে।
কারা মহাপরিদর্শক কার্যালয়ের ডিআইজি প্রিজন (অধিদফতর) মো. বজলুর রশীদ বলেন, ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ৪৮ জনের জড়িতের বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি। তিনি বলেন, যেকোনো তদন্তের বিষয়টি গোপনীয়। তাই এ ব্যাপারে এখন কিছু বলা সম্ভব নয়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-