কক্সবাজার জার্নাল ডেস্ক :
পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার জেলা কারাগারে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে, তাদের কাছে খাবার ও অন্যান্য জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে, মোবাইলে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে এই অর্থ আদায় করা হয়েছে।
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রিপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম ঈদের পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজার কারাগারে বন্দি শাহাব উদ্দিনকে দেখতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘বন্ধুর জন্য খাবার এনেছিলাম। ওই খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য কারারক্ষীকে দিতে হয়েছে ৬০০ টাকা। সঙ্গে কিছু পান-সিগারেটও কিনে দিয়েছি। কারা অভ্যন্তরে ক্যান্টিন থেকে চার প্যাকেট সিগারেট ও ১০ খিলি পান কিনতে খরচ হয়েছে ২৫০ টাকা। ক্যান্টিনে যে কোনো জিনিস দুই থেকে তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে কিনতে বাধ্য করা হয়।’
কারাগারের ক্যান্টিন থেকে কোনো পণ্য কিনলে রসিদ দেওয়া হয় কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল কালাম বলেন, ‘আমাদের কোনো রসিদ দেওয়া হয়নি। অন্য কাউকেও রসিদ দিতে দেখিনি। রসিদ ছাড়া সবাই বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হন।’ কারা ফটকের সামনে কথা হয় মোহাম্মদ হোছেন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অফিস কল দিয়ে আমার ভাইকে দেখেছি। এ জন্য ১২০০ টাকা দিতে হয়েছে। অফিসে আলাদাভাবে একজন বন্দির সঙ্গে দেখা করার জন্য পরিবারের চারজনকে নিয়ে যাওয়া যায়। টাকা দিলে সবই সম্ভব এখানে।’ সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর মোহাম্মদ হোছেন আর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কক্সবাজার কারাগার ঘুরে দেখা গেছে বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন তাদের কয়েক হাজার আত্মীয়-স্বজন। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঘুষ বাণিজ্য করেছেন কারারক্ষীরা। কারাগারের মূল ফটক থেকে শুরু করে ভেতরে, মাঠে, লোকজনের সঙ্গে কারারক্ষীদের কথা বলতে দেখা গেছে। ভেতরে এক স্থানে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের নাম-ঠিকানা লিখতে হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় বাণিজ্য।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কারাগারের মূল ফটক থেকে ভেতরে যেতে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার বাণিজ্য হয়। বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, হাসপাতালে থাকা, আসামির জামিন, বন্দি রোগী বাইরের হাসপাতালে পাঠানো, তাদের কাছে খাবার বা টাকা পাঠানো- সবক্ষেত্রেই বাণিজ্য হয়। ঈদের পরদিন বৃহস্পতিবার সারাদিন কারাফটকের বাইরে ও ভেতরে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
টেকনাফ থেকে ইয়াবা মামলায় আটক স্ত্রী ও ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন মো. সেলিম নামে একজন। তিনি বলেন, ‘কারাগারের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের আগে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের মোবাইল জমা রাখা হয় ডানপাশের একটি বুথে। সেখানে একটি মোবাইল জমা রাখার জন্য দিতে হয় ২০ টাকা। দুটি মোবাইল জমা রাখার জন্য বুথে দিতে হয়েছে ৪০ টাকা। স্ত্রী ও ভাইদের জন্য কিছু কাপড়-চোপড় এনেছিলাম। সেগুলো ভেতরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কারারক্ষীকে দিতে হয়েছে ৩০০ টাকা। এখন বিকেল সাড়ে ৪টা। দেখা করতে পারিনি। দেখা করার জন্য আরও টাকা দিতে হবে। দুই দিন আগে টেকনাফ থানা থেকে তাদের কক্সবাজার জেলা কারাগারে আনা হয়েছে। তখন কাপড়-চোপড় কিছুই দিতে পারিনি।’ কারাগারে কয়েদিদের মুঠোফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভেতরে দায়িত্বরত কারারক্ষীদের সহায়তায় মুঠোফোনে কথা বলেন বন্দিরা। এর প্রমাণ পাওয়া গেল স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে আসা সেলিমের কথায়। তিনি বলেন, ‘ভেতরে লিপি নামে একজন নারী কারারক্ষী আমাকে একটি কাগজে তার মোবাইল নম্বর লিখে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যখনই প্রয়োজন হয় তাকে ফোন দিতে। তাই তার মোবাইল নম্বর নিয়েছি।’
এ বিষয়ে জানতে কারারক্ষী লিপির দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ অভিযোগ সত্য নয়। আমি কখনই এ ধরনের কাজ করি না।’
কারা ফটকের সামনে দেখা হয় কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ার এক বাসিন্দার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘টেকনাফের সাবরাং থেকে শাহজাহান নামে আমার একজন বন্ধু এসেছিলেন তার বড় ভাইকে দেখতে। তার সঙ্গে আরও চারজন ছিলেন। তারা এখানে কিছু চেনেন না বলে ফোন করে আমাকেও নিয়ে এসেছেন। কারাগারে অফিস কল করে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আড়াই হাজার টাকা দিতে হয়েছে। ওয়্যারলেস নিয়ে জেলারের সঙ্গে থাকেন- এমন একজন ওই টাকা নিয়েছেন।’
কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডী এলাকা থেকে ছেলেকে দেখতে এসেছেন মধ্যবয়স্ক নারী গোলবাহার। তিনি বলেন, ‘ছেলের জন্য রান্না করা খাবার এনেছিলাম। ওই খাবার পাঠাতে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে কারারক্ষীকে।’
কক্সবাজার শহরের বৈদ্যঘোনা এলাকার বাসিন্দা খালেদা বেগম। তিনি এসেছিলেন কারাবন্দি ভাই মহিউদ্দিনকে দেখতে। ঈদ উপলক্ষে তার জন্য কিছু রান্না করা খাবারও নিয়ে এসেছিলেন বাড়ি থেকে। তিনি বলেন, খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য কারারক্ষীকে দিতে হয়েছে ৪০০ টাকা।
স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে খুব সকাল থেকে কারাগারে এসে দিনভর অপেক্ষার পরও দেখা করতে না পেরে ফিরে গেছেন অনেকে। তেমনই একজন রামুর খুনিয়ার পালংয়ের বাসিন্দা মিজানুর রহমান। বন্ধু বেলাল উদ্দিনকে দেখতে এসেছিলেন তারা তিনজন। তিনি বলেন, ‘আজ দিনভর অপেক্ষা করেও দেখা করতে পারিনি। ওরা বলেছে, আজ দেখা করা যাবে না। অথচ দেখলাম টাকা দিলেই বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে।’
কারাভোগ করে সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পাওয়া মহেশখালীর একজন বলেন, ‘টাকা থাকলে কক্সবাজার কারাগারে অনেকটা রাজার হালে থাকা যায়। এক মাসের জন্য ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিলে কারাগারে মেডিকেল ওয়ার্ডে থাকতে পারেন সুস্থ বন্দিও। ওই টাকা দিতে হয় অগ্রিম। টাকা দিলে সেখানে সব সুযোগ-সুবিধা মেলে। ভালো খাবারও পাওয়া যায়। কারারক্ষীরাও তাদের তোয়াজ করেন। টেকনাফের বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অনেকে মেডিকেল ওয়ার্ডে থাকেন।’ তিনি বলেন, এখানে কারাবন্দিদের প্রায় ৭০ শতাংশই ইয়াবাসংক্রান্ত মামলায় অভিযুক্ত। তাদের বিশেষ কদর রয়েছে কারাগারে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজার কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক বজলুর রশিদ আখন্দ বলেন, ‘কারাগার থেকে যারা অনৈতিক সুবিধা নিতে পারে না, তারাই মূলত নানা ধরনের মিথ্যা অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।’
তিনি বলেন, ‘শুক্রবার পর্যন্ত কক্সবাজার কারাগারে বন্দি আছেন ৪ হাজার ২৬৭ জন। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই ইয়াবাসংক্রান্ত মামলায় অভিযুক্ত।’
/সূত্র: সমকাল
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-