দশ বছর ধরে অধরা উখিয়ার ইয়াবা কারবারি জয়নাল মেম্বার

বিশেষ প্রতিবেদক :

এক সময় কক্সবাজার জেলা ডিবি পুলিশের সোর্স হিসাবে নাম লিখিয়ে শুরু করেছিলেন ইয়াবা কারবার। সেই কারবারি পরবর্তীতে উখিয়া থানা পুলিশের সবচেয়ে বেশী নির্ভরশীল ইয়াবা সোর্স হিসাবে পরিচিত লাভ করে। ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে এই কারবারির ইয়াবা কারবার। চারিদিকে তিনিই এবার নিয়োগ দিতে শুরু করেছেন ইয়াবা কারবারের সোর্স। কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবিরের ইয়াবার বাজারও নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে তিনি লাগাতার কারবার করে আসলেও উখিয়া থানা পুলিশের কাছে তিনি অধরাই থেকে গেছেন।

এমন ভাগ্যবান ইয়াবা কারবারির নাম জয়নাল আবেদীন (২৯) প্রকাশ ইয়াবা জয়নাল মেম্বার। তিনি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের একজন মেম্বারও। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন পালংখালী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তাজনিরমার খোলা এলাকার জয়নাল আবেদীন প্রকাশ ইয়াবা জয়নাল মেম্বার কেবল একজন ইয়াবা ডন নন। গত কয়েক বছর আগেও জয়নাল ছিলেন কুতুপালং শিবিরের নিরাপত্তা প্রহরী। তিনি এলাকায় একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসাবেও এক নামে পরিচিত।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার রাজনীতির আদর্শে লালিত দল বিএনপি’র পালংখালী ইউনিয়ন শাখার অর্থ সম্পাদক এবং উখিয়া উপজেলা যুবদলের একজন সামনের সারির নেতা হচ্ছেন ইয়াবা জয়নাল। রমরমা ইয়াবা কারবারের আয়ের লাখ লাখ টাকা বিএনপি রাজনীতির জন্য দেদারছে খরচ করার ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। এ কারনেই তাকে সংগটনের অর্থ সম্পাদক করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি নেতা ইয়াবা জয়নাল তার কারবার সামাল দিতে স্থানীয় তৃণমূল আওয়ামী লীগের কর্মীদের ব্যবহার করে থাকেন। আর পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সহযোগিতায় আয় করা টাকাই আবার তিনি ব্যয় করেন আওয়ামী লগি রাজনীতি ধ্বংসের কাজে।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আবুল খায়ের গতরাতে এ প্রসঙ্গে জানান-‘ গত ২৬ মে রাতে ইয়াবা জয়নাল মেম্বারের ঘরে স্থানীয় এলাকার বালু ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা কারবারের এক বৈঠকের খবর পেয়ে আমি একদল পুলিশ নিয়ে তার ঘর ঘেরাও করেছিলাম। সেই ঘরের বৈঠক থেকে একটি অবৈধ বন্দুক ও তিন রাউন্ড গুলি সহ ১০ জনকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু এক মহা রহস্যজনক কারনে ইয়াবা জয়নালকে আটক করা যায়নি।’

ওসি বলেন, বৈঠক থেকে সে কিভাবে পালিয়ে গেল তাই বুঝা গেল না। পরে জিজ্ঞাসাবাদের পর শেখ আলম নামের অস্ত্রের মালিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হলেও মেম্বার ইয়াবা জয়নালকে পলাতক আসামীও মামলায় দেখানো হয়নি। এখানেই পুলিশের বিরুদ্ধে এলাকার সচেতন লোকজন সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন-আসলে পুলিশের কারনেই মেম্বার জয়নাল আবেদীন শণৈ শণৈ ইয়াবা কারবারে এভাবে এগিয়ে গেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপি নেতা মেম্বার জয়নাল আবেদীনের একটি সশস্ত্র গ্রুপও রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র। অবৈধ অস্ত্রধারীদের নিয়েই ইয়াবা কারবারি জয়নাল এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। তবে এলাকার মানুষের নিকট একটি আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে-সরকার বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়েও তিনি প্রকাশ্যে চালানে চালানে ইয়াবার কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন একদম প্রকাশ্যে। উখিয়া থানা পুলিশ এ যাবত এই ইয়াবা জয়নালের ধারে কাছেও যেতে পারেননি।
সবচেয়ে বড় অভিযোগ ইয়াবা জয়নালের বিরুদ্ধে যা উঠেছে তা হচ্ছে-কক্সবাজারের বিদায়ী পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেনের সময় উদ্ধার করা দশ লাখ ইয়াবার যে চালানটি নিয়ে দেশব্যাপি পুলিশের বিরুদ্ধে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে সেই চালানের একটি অংশ তিনি (জয়নাল) নিজেই বিক্রি করেছেন। বিএনপি নেতা জয়নাল স্থানীয় কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবিরের ইয়াবা কারবারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিবিরে মারকাজুল নামের একটি বেসরকারি এনজিও’র বিপুল অংকের টাকা আতœসাতের বিষয়ে জয়নাল মেম্বার জড়িত থাকার কথা উঠেছে। এ বিষয় নিয়ে গতরাতে জয়নাল মেম্বারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন-‘আপনি কি জানেন, ওই মারকাজুল এনজিও’র মালিক হচ্ছেন দেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি সালমান এফ রহমান। উনার এনজিও’র টাকা মার গেলে দেশে কেউ থাকতে পারবেন-বলেন জয়নাল মেম্বার।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জয়নাল মেম্বার কক্সবাজার জেলা ডিবি পুলিশের সোর্স হিসাবে নিয়োজিত হয়েই কাজ শুরু করেছিলেন। ডিবি পুলিশ জয়নালকে দিয়েই ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের প্রথমার্ধ সময় পর্যন্ত টেকনাফ-কক্সবাজার মহাসড়কে ফাঁদ পেতে যা করার ছিল তাই করেছেন। ডিবি পুলিশের উদ্ধার করা ইয়াবা টেবলেট বিক্রি করতেন জয়নাল। ডিবি পুলিশের ৭ সদস্য মেরিন ড্রাইভ সড়কে ১৭ লাখ টাকা সহ সেনা সদস্যদের হাতে ধরা পড়ার পর থেকেই ডিবি’র কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর জয়নাল মেম্বার ভীড়েন থানা পুলিশের সাথে। উখিয়া থানা পুলিশের সোর্স হবার পর থেকেই জয়নালকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জয়নাল পুলিশের সোর্স হবার কারনে তিনি কোনভাবেই ধরা পড়েন না। ইয়াবা কারবারি জয়নালের অপরাধ কর্মকান্ড এখানেই শেষ নয়। তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা রমণী ধর্ষণের অভিযোগও রয়েছে। এ ধর্ষণ মামলায় তিনি ইতিমধ্যে কারাগারে গিয়েছিলেন। তদুপরি জয়নাল রোহিঙ্গা শিবিরে ইয়াবা কারবারেও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরের আরিফুল্লাহ হত্যার ঘটনায়ও তার সম্পৃত্ততা নিয়ে কথা উঠেছে।

এসব বিষয় নিয়ে গতরাতে বিএনপি নেতা মেম্বার জয়নাল আবেদীনের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব অভিযোগ সমূহ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন-‘আমি ইয়াবা কারবারে জড়িত নই। গত দশ বছরেও পুলিশ আমাকে ধরতে পারেনি। আমি কারবারে জড়িত থাকলে অবশ্যই আমি এভাবে প্রকাশ্যে থাকতে পারতাম না। রোহিঙ্গা রমনী ধর্ষণের ঘটনায়ও পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করেনি। আমিই বরং আদালতে আতœসমর্পণ করলে আদালত আমাকে কারাগারে প্রেরণ করেন।’

আরও খবর