ভারী অবকাঠামো সোনাদিয়াকে ধ্বংস করবে

আজিম নিহাদ :

সোনাদিয়া দ্বীপে বহুতল দালান বা ভারী অবকাঠামো তৈরী করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার নামে পর্যটকদের অবাধ বিচরণ হলে অচিরেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মত অস্থিত্ব সংকটে পড়ে যাবে। তাই দ্বীপ রক্ষার স্বার্থে সোনাদিয়ায় ভারী কোন অবকাঠামো করা যাবে না। সীমিত পরিসরে পরিবেশবান্ধব পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে।

সোনাদিয়া দ্বীপকে নিয়ে গত এক বছর ধরে গবেষণা করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে দুটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের সমীক্ষায় এতথ্য উঠে এসেছে।

রোববার (১২ মে) কক্সবাজার শহরের একটি হোটেলের সম্মেলন কক্ষে ‘সোনাদিয়া-ঘটিভাঙা দ্বীপে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কারিগরি এবং পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণসহ সম্ভ্যাবতা সমীক্ষা’ শীর্ষক সমীক্ষা প্রকল্পের কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে।
সোনাদিয়ায় বেজার অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে পুন: সমীক্ষা করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড এক বছর আগে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডাব্লিউএম ও সিইজিআইএসকে দায়িত্ব দেয়। বিগত এক বছর ধরে সংস্থা দুটি সমন্বয় রেখে এই সমীক্ষা চালিয়েছে। সংস্থা দুটি যৌথভাবে এই সমীক্ষার প্রতিবেদন অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। তবে তাদের প্রতিবেদনের সাথে বেজার সমীক্ষার প্রতিবেদনের বৈপরীত রয়েছে। তাই বেজাকে তাদের সমীক্ষা সংশোধন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, অর্থনৈতিক অঞ্চল করার জন্য সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙার কিছু অংশসহ ৯ হাজার ১০০ একর জমি বরাদ্দ পেয়েছে বেজা। সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত মতে আনুষঙ্গিক কর্মকান্ডের প্রকল্প হাতে নিয়েছে বেজা। এই জন্য বেজার পক্ষ থেকে প্রাথমিক একটি সমীক্ষাও চালানো হয়েছিল। সমীক্ষার পর নিরাপত্তাজনিত অবকাঠামো তৈরি করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

তবে সোনাদিয়া ও আশেপাশের এলাকা প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বেজার সমীক্ষা প্রতিবেদনের আরো অধিকতর যাচাইয়ের জন্য পুন: সমীক্ষার উদ্যোগ নেয়।

সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশের কর্মশালায় জানানো হয়, বেজার সমীক্ষার সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষার প্রতিবেদনের কিছুটা বৈপরীত্য রয়েছে। সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র রক্ষায় এই প্রতিবেদনের আলোকে বেজার প্রতিবেদন সংশোধন করতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙ্গার নিয়ে অংশ নিয়ে বেজা যে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তা করার উপযোগিতা রয়েছে। তবে শিল্প-কারখানা নয়, পর্যটন ভিত্তিক পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে হবে। পর্যটন ভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়লেও তার একটা সীমাবদ্ধতা থাকবে হবে।

প্রতিবেদনের তথ্য মতে, সোনাদিয়া একটি জোয়ার-ভাটা সমৃদ্ধ পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা। সুবিশাল সাগরের হাতছানি, চমৎকার প্যারাবন, ঝাউবাগান, পরিযায়ী পাখির আবাস্থল, কচ্ছপের প্রজননকেন্দ্রসহ নানাভাবে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্রের একটি লীলাভূমি। সব মিলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সব ধরণের পরিবেশগত উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। এই চিত্র বিবেচনায় দ্বীপটিতে কোনো ধরনের ভারী অবকাঠামো নির্মাণ ব্যতিরেখে ইকোট্যুরিজম করা যাবে। ইকোট্যুরিজম বাস্তবায়ন করা হলেও তার সীমাবদ্ধতা রাখতে হবে।

তার জন্য পায়ে হেঁটে দ্বীপ ভ্রমণের জন্য প্রাকৃতিক পথ, প্যারাবন সৃজন, বন্যপ্রাণী পুনর্বাসন, কচ্ছপের আবাসস্থল সংরক্ষণ, পাখিদের অভয়ারণ্য নিশ্চিতকরণ, পরিবেশ বান্ধব হোটেল-মোটেল তৈরি করতে হবে।

তথ্য মতে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সোনাদিয়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতায় স্বাদু পানির পুকুর খনন, সৌর শক্তির ব্যবহার, গলফ ও লন টেনিস খেলার মাঠ তৈরি, শিশুদের জন্য বিনোদন পার্ক, সুইমিলপুল, মসজিদ, জাদুঘর, কমিউনিটি সেন্টার তৈরি, রেগুলেটর সংস্কার এবং নদী ও সমুদ্র ভ্রমণের জন্য হারবার সুবিধাদি স্থাপন করা যাবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদী ভ্রমণের জন্য ৩৩ কি.মি. এবং সমুদ্র ভ্রমণের জন্য ৭০ কি.মি. পথ করা যাবে। প্রতিদিন তিন শিফটে নদী ভ্রমণ এবং এক শিফটে সমুদ্র ভ্রমণ করা যাবে। প্রতি নৌযানে ৪০জন এবং সমুদ্রভ্রমণের নৌযানে সর্বোচ্চ ১২০ জন পরিবহণের সক্ষমতা থাকবে। পায়ে হাঁটার প্রাকৃতিক পথ হবে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১৬ কি.মি. এবং কাঠ, বাঁশ এবং অন্যান্য স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে পথটি তৈরি করা করতে হবে। দ্বীপের সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য আরো প্যারাবন সৃজন করতে হবে। বিভিন্ন উৎস হতে হরিণ ও বানর এনে প্যারাবনে অবমুক্ত করতে হবে। সুপেয় পানির জন্য গভীর নলকূপ ও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য রিটেশন পুকুর করতে হবে। ১.১৮ বর্গ কি.মি’র ১২টি রিটেশন পুকুর করতে হবে। ঘটিভাঙ্গা এলাকায় পরিবেশ বান্ধব হোটেল-মোটেল করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এসব হোটেল-মোটেল পরিচালনায় পরিবেশ দূষণ সর্বনি¤œ পর্যায়ে রাখতে হবে। ২০ জনের ধারণ ক্ষমতার সর্বোচ্চ ১০ হোটেল-মোটেল করা যাবে।

প্রতিবেদনে তিন একর জায়গার উপর শৈবাল (স্পিরিলুনা চাষ, মুক্তা চাষ এবং কমিউনিটি ট্যুরিজম এর সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ৩০ একর জমির উপর ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটি সৌর বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। বেজার প্রতিবেদনে দ্বীপে বেড়িবাঁধ দেয়ার কথা থাকলেও এই প্রতিবেদনে বাঁধের বিষয়টি নাকচ করা হয়েছে। কারণ বাঁধ দিলে সেখানকার পুরো ইকো সিস্টেম ভেঙে পড়বে।

সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতকারীর কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সোনাদিয়া পর্যটনের অপার সুযোগ তৈরি হবে। আয়-ব্যয়ের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রকল্পটি আর্থিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক। সার্বিক বিবেচনায় সোনাদিয়া-ঘটিভাঙ্গা দ্বীপে ইকোট্যুরিজম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিইজিআইএস’র প্রকৌশলী শাকিল আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা সমীক্ষাটি চালিয়েছি। সমীক্ষায় প্রতিটি বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। সব বিষয় পুংখানুপুঙ্খভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অত্যন্ত নিবিড় গবেষণা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।’
সিইজিআইএস’র পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সৌরভ মাহমুদ বলেন, ‘ প্রকাশিত সমীক্ষার এই প্রতিবেদনটি এখনো খসড়া। কিছুদিনের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে তা কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হবে।’

কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী (চট্টগ্রাম জোন) মীর মোশারফ হোসেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) এ. এম আমিনুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্ব রিজিয়ন) একেএম সামছুল করিম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা ফজলুর রশিদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রুহুল আমিন, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম সরওয়ার কামাল ও কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুর।

আরও খবর