শীর্ষ ২০ ইয়াবা গডফাদার বহাল

মির্জা মেহেদী তমাল,বাংলাদেশ প্রতিদিন::

টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশ প্রধান ড. জাবেদ পাটোয়ারীর হাতে ইয়াবা ও অস্ত্র তুলে দিয়ে তালিকাভুক্ত ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। সরকারের এই আহ্বানে যারা সাড়া দেননি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

অথচ সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন সরকারের তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদার ও টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ। যিনি দেশের ইয়াবা সাম্রাজ্যের তিন ডনের এক ডন। এ সময় তার সঙ্গে আরও ছিলেন তালিকাভুক্ত আরেক ইয়াবা কারবারি শাহজাহান। এই শাহজাহান হলেন জাফর আহমেদের ছেলে এবং টেকনাফের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদার জিয়াবুল হক এবং কবির আহমেদ। উখিয়া থানা পুলিশ তাদের দুজনকেই গ্রেফতার করে। পরে তাদের ৫ হাজার করে ইয়াবা ও অস্ত্রসহ আদালতে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া যায়, এই দুই কারবারিকে গ্রেফতারের পর অন্তত সাত দিন তাদের আটকে রাখা হয়। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের সঙ্গে দফারফা হয়। কিছু ইয়াবা দিয়ে তাদের আদালতে পাঠিয়ে দেয়। এর কিছুদিন পর একই থানা পুলিশ সাইফুল, মোক্তার এবং মোস্তাক নামে তিন ভাইকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ইয়াবা ব্যবসায়ী। কিন্তু ইয়াবা ব্যবসা করেন, এমন কোনো তথ্য এলাকা ঘুরে পাওয়া যায়নি। এক সময় ছোট ভাইকে ছেড়ে দেওয়া হয় দেন দরবার করে। কিন্তু ছোট ভাই তার দুই ভাইকে ছাড়িয়ে আনার জন্য টাকা জোগাড় করতে পারেননি। পরে দুই ভাইয়ের লাশ উদ্ধার হয়।

আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে ইয়াবা সাম্রাজ্যের ডন জাফরের উপস্থিতি সর্বমহলে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। স্থানীয়রা বলছে, আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে জাফরের উপস্থিতি গোটা অনুষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ১০২ জন আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে অধিকাংশই চুনোপুঁটি। এই আত্মসমর্পণ কোনো প্রভাব পড়েনি ইয়াবা পাচারে। আত্মসমর্পণ করেনি এমন অন্তত ২০ জন ইয়াবা গডফাদার এখন প্রকাশ্যে। তারাই ইয়াবার ব্যবসা করছেন রুট পরিবর্তন করে। তাদের ব্যবসা আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। তাদের কেউ অবশ্য দুবাই সিঙ্গাপুরমহ বিভিন্ন দেশে থেকে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। জাহাজ, উড়োজাহাজ এমনকি হেলিকপ্টারেও এখন ইয়াবা পাচার হচ্ছে। তবে এসব গডফাদার তাদের পাচারের কৌশল অনেকটাই পরিবর্তন করেছেন। তাদের ব্যবসা এখন চালাচ্ছে রোহিঙ্গাদের দিয়েই। ভোরে রোহিঙ্গাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় মিয়ানমার সীমান্তে। তারা অপেক্ষায় থাকে সেখানে ইয়াবার জন্য। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপি এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করছে। তারাই রোহিঙ্গাদের হাতে তুলে দিচ্ছে ইয়াবার চালান। সেই ইয়াবা তারা নিয়ে ফিরে আসে তাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখান থেকেই এখন ইয়াবা সরবরাহ করা হয় সারা দেশে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ইয়াবাবিরোধী অভিযান ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের পরও ইয়াবা পাচার থামছে না। বরং ইয়াবা পাচারে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে, বাহক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। হেলিকপ্টারে করে ইয়াবা পাচার হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ নিয়ে ছয়টি বেসরকারি হেলিকপ্টার সার্ভিসের মালিকদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। আর অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহনের যাত্রীদের এই সন্দেহের বাইরে রাখা হয়নি।

ইয়াবা পাচারের আরও কৌশল

এদিকে গত ২৯ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফে ১৩ রোহিঙ্গার পেটের ভিতর থেকে ৪৩ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। টেকনাফ সীমান্ত অতিক্রম করা ২৩ রোহিঙ্গাসহ ২৬ জনকে ইয়াবাসহ আটক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এক্স-রে করে এদের মধ্যে ১৩ রোহিঙ্গার পেটে ইয়াবা নিশ্চিত হওয়া যায়। তাদের প্রত্যেকের পেটে ৩ হাজার পিসেরও বেশি ইয়াবা পাওয়া যায়।

থামছে না ইয়াবা

গত শুক্রবার ভোর রাতেও কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পৃথক অভিযানে ১ লাখ ৭০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। ভোররাত ৪টার দিকে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ফাইসাখালী ও টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের মিনাবাজার মোরাপাড়া এলাকা থেকে এসব ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। তবে কেউ আটক হয়নি। গত বছরের মে মাস থেকে বাংলাদেশে বিশেষ করে কক্সবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। এ পর্যন্ত এই অভিযানে শুধু কক্সবাজার এলাকায়ই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৬৩ জন নিহত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে ১০২ জন মাদক পাচারকারী আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু তারপরও থামছে না ইয়ারা পাচার ও ইয়াবা কারবার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই কক্সবাজারে ১১ লাখ ২০ হাজার ২৫১ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় ৩১৩ জনকে গ্রেফতার এবং ১৫৫টি মামলা করা হয়েছে। মার্চ মাসেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। মার্চে শুধু টেকনাফের সীমান্ত এলাকা থেকে ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৫৪ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে বিজিবি।

কেন থামছে না ইয়াবা পাচার

ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একজন বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযানে কোনো ইয়াবা গডফাদার বা মূল ব্যবসায়ীদের কেউ গ্রেফতার হয়নি। আর যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের মধ্যে গডফাদাররা নেই। তারা মূলত ক্যারিয়ার। ফলে ইয়াবার মূল ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। তারা রাজনৈতিক বা অন্য কোনো পরিচয়ে বলতে গেলে প্রকাশ্যেই আছে। ফলে ক্যারিয়ার হিসেবে নতুন অনেক লোক যুক্ত হয়েছে। কৌশলে পরিবর্তন হয়েছে, রুট বদলেছে।’ তিনি বলেন, ‘নাফ নদে এবং সমুদ্রপথে ইয়াবা ঢুকছে কক্সবাজারে। আর এখন উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে ইয়াবা বহনে। ইয়াবা কারবার এবং পাচার একটুও কমেনি।’

কক্সবাজরের একটি স্থানীয় সূত্র জানায়, ‘মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একাংশ এখন আর কক্সবাজারকে মধ্যবর্তী এলাকা হিসেবে ব্যবহার করছে না। তারা তাদের যোগাযোগের মাধ্যমে সরাসরি ঢাকা বা উত্তরবঙ্গে ইয়াবা পাঠাচ্ছে। আর যারা প্রথমে কক্সবাজারে নিয়ে আসে তারা রোহিঙ্গাদের শিবিরগুলো ইয়াবা মজুদ রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ মনে করে তাই এখন তাদের এই অবৈধ মাদক ব্যবসায় ব্যবহার করা হচ্ছে।’ আত্মগোপনে আছেন তাদের মধ্যে তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদার হলো- সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি, ভাই কাউন্সিলর মৌলভী মুজিবুর রহমান, সারা দেশের আলোচিত ইয়াবা ডন হাজী সাইফুল করিম, জালিয়াডপাড়ার জাফর আলম প্রকাশ টিটি জাফর, টেকনাফের উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ ও তার ছেলে টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজাহান মিয়া, বাহারছড়ার ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও তার ভাই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন, উখিয়া গুয়অলিয়ার ইউপি সদস্য মোস্তাক আহমদ, নুরুল হক ভুট্টো, কক্সবাজার শহরের বাস টার্মিনাল এলাকার শাহাজান আনসারী, তার ভাই কাশেম আনসারী, একই এলাকার আবুল কালাম ও তার ভাই বশির আহমদসহ অন্তত ২০ জন।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ সাহা বলেন, যারা এখনো আত্মসমর্পণ করেননি তাদের জন্য সামনে খুব কঠিন সময় আসছে।

আরও খবর