শাহীন মাহমুদ রাসেল :
এক বছর বা দুই বছর নয় দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরেই মৃত মানুষের জন্য তাদের শেষ ঠিকানা কবর খুঁড়ে চলছেন তিনি। প্রায় পাঁচ শতাধিক কবর খুড়েছেন এবং সেগুলোতে শুয়েছেনও।
মোজাফফর আলী, বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। কিন্তু তার মনোবল ও পরিশ্রম দেখে মনে হয় এখনো ২৫ বছরের টগবগে যুবক। পেশায় একজন দিনমজুর। অন্যের বাড়িতে কাজ করার পাশাপাশি একটি মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। কোথাও মানুষ মারা যাওয়ার খবর তার কানে আসলে শত ব্যস্ততা রেখে ছুটে যান কবর খুঁড়তে। এভাবে ৪০ বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে কবর খুঁড়ে চলছেন তিনি।
মোজাফফর আলী কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের খরুলিয়া কোনার পাড়া এলাকার বাসিন্দা। দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। তার পিতার নাম মৃত মোহাম্মদ।
একপর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে মোজাফফর আলী বলেন, এলাকার অনেকে কিছু অযাচিত প্রশ্ন করে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা মসকারা ও ট্রল করে। যা মুখ বুঝে সয্য করি।
মোজাফফর আলী জানান, এক সময় দিনে তিনটি কবরও খুঁড়েছেন কিন্তু বার্ধক্যের কারণে এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। যখন তার বয়স ৩০ বছর তখন থেকে তিনি কবর খুঁড়েন। মানুষ মারা গেলে কবর খোঁড়ার ডাক পড়ে। সরঞ্জাম নিয়ে চলে যান কবর খুঁড়তে। আবার মানুষ মারা যাওয়ার খবর তার কানে আসলে শত কাজ রেখে ছুটে যান তিনি। তার এলাকা ও আশপাশের প্রায় ৩৬টি কবরস্থানে ৪০ বছর ধরে প্রায় ৫ শতাধিক কবর খুঁড়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রথমে লাশ দেখে কবরের পরিমাপ করি। তারপর কবর তৈরির কাজ শুরু করি। পুর্ণাঙ্গ কাজ শেষ হওয়ার পর শুয়ে দেখি ঠিক হয়েছে কি-না। কবর খুঁড়ার জন্য নিজের টাকায় দুটি খন্তা, দুটি কোদাল, দুটি তেরপাল, বালতি, বেলচা, দা, করাত কিনেছেন মোজাফফর আলী। তিনি রামু ও সদরসহ পাশ্ববর্তি উখিয়া-টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কবর খুঁড়ে থাকেন। এজন্য তিনি কোন পারিশ্রমিক নেন না।
তিনি আরোও বলেন, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী অথবা অপরিচিত যেই হোক না কেন মৃত্যুর খবর শোনা মাত্রই ছুটে যাই কবরস্থানে। নিয়ম অনুযায়ী কবর খুঁড়ে দিয়ে আসি। শুধু কবর নয় তার জানাজার নামাজেও শরীক হই। অনেক পরিবারের মানুষ কবর খোঁড়ার জন্য টাকা দিতে আসে কিস্তু আমি সেটা নেই না। কারণ আমি মনে করি এটা একটা মহত ও ভালো কাজ। আমাকেও তো একদিন মরতে হবে। মাটির ঘর কবরে যেতে হবে সবাইকে। এ কাজটি করলে মন থেকে প্রশান্তি পেয়ে থাকি। তা ছাড়া আমি মনে করি মহান আল্লাহ এ কাজের জন্য হয়তো আমাকে ও আমার সকল পাপ কাজকে ক্ষমা করে দেবেন।
এখন অন্যের জমি বন্ধক রেখে চাষাবাদ করে চলে যাচ্ছে মোজাফফর আলীর সংসার। তিনি বলেন, এখনো আমি কঠোর পরিশ্রম করি। হয়তো এই কাজ করার কারণে আল্লাহর রহমতে আমার শরীরে কোন রোগ বালাই নেই। যতদিন বেঁচে থাকবো এই কাজ করে যাবো ইনশাআল্লাহ।
এই বিষয়ে ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, ব্যক্তিগত তহবিল থেকে প্রতিটি মসজিদে কবর খুঁড়ার সরঞ্জাম দিয়েছি। কবর খোঁড়া একটি মহৎ কাজ। এই কাজ সবাই করতে পারে না। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো এই কাজ করে থাকেন। মানুষ মারা গেলে নিজের শত কাজ রেখে ছুটে যান কবর খুঁড়তে। তাদের মধ্যে অন্যতম মোঃ আলী। তিনি ৪০ বছর ধরে অনেক কবর খুঁড়েছেন। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।
স্থানীয় সেচ্ছাসেবী সংগঠন অমাখোঁর পরিচালক শরিয়ত ও ফয়সাল বলেন, গত বছর থেকে আমারা ইউনিয়নে সামাজিক বিভিন্ন কাজে অবদান রাখায় প্রায় ৫ জনকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করেছি। এবার কবর খুঁড়ার কাজ করা ২ জন কে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করবো এবং আমরা মনে করে করি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য অনেককে সম্মানিত করা হয়। কিন্তু মানুষ মারা গেলে যারা ছুটে যায় তাদের কেউ খবর রাখে না। সকলের উচিৎ মোজাফফর আলীর মত মানুষদের সম্মান করা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-