সন্ত্রাসের জনপদ হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবির!

তোফায়েল আহমদ ও জাকারিয়া আলফাজ, রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে :

সাধারণ রোহিঙ্গারা ভুলক্রমেও পুলিশ বা সেনা সদস্যদের ধারেকাছে যেতে চায় না। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কোনো সদস্য দেখে ফেললে নিশ্চিত খুন বা গুম—এমন ভয়েই তারা (সাধারণ রোহিঙ্গারা) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এড়িয়ে চলে। এমনকি বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটার পরও ক্ষতিগ্রস্ত বা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিটি পুলিশ ফাঁড়ি বা ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে বিচার চাইতে যেতে পারে না। সশস্ত্র রোহিঙ্গার দল যখন যেটা চায় সেটাই তাদের কাছে সাধারণ রোহিঙ্গারা পৌঁছে দিতে বাধ্য।

অবিশ্বাস্য হলেও এ রকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে টেকনাফ সীমান্তের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে। শিবিরটির প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ‘নকল আরসা’ নামের একটি সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। শিবিরটির বাস্তব চিত্র জানার জন্য তিন দিন ধরে চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত গতকাল সোমবার নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। কয়েকজন সাধারণ রোহিঙ্গাকে শিবিরের বাইরে নিয়ে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে যা জানা গেছে, তা এককথায় ভয়াবহ।

নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের সাতটি ব্লকের ২৫ হাজার রোহিঙ্গাকে জিম্মি করে রেখেছে মাত্র জনাদশেক সশস্ত্র দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গার নেতৃত্বে ‘নকল আরসা’ নামে পরিচিত সশস্ত্র গ্রুপের লোকজন। বর্তমানে গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা আবদুল আমিন, জহির আহমদ জকির, সেলিম, ছাদেকুল্লাহ, হামিদ মাঝি, আবদুল করিম ধইল্যা, মোহাম্মদ নূর ও নেসার আহমদ। তাঁদের নেতৃত্বে কয়েক শ রোহিঙ্গা যুবক সীমান্তের আরো কয়েকটি শিবিরজুড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

‘আরসা’ নামের একটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের বি টিম হিসেবে কাজ করছে এই ‘নকল আরসা’। দোস্ত মোহাম্মদ নামের এক সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা বেশ কিছুদিন ধরে কারাগারে। নয়াপাড়া শিবিরে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গার দল গঠনের নেপথ্যের কারিগর এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাতটি মামলা রয়েছে। এসব মামলার তদবির করেন মোসতাক মাঝি নামের আরেক রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা মোসতাকও একসময় নয়াপাড়া শিবিরের শেড মাঝি (দলনেতা) ছিলেন। পরে তিনি শিবির থেকে বাইরে গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং বাংলাদেশের ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে যান। দোস্ত মোহাম্মদ শিগগির কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন—এমন ভাবনা থেকে শিবিরটিতে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের ‘নকল আরসা’ গ্রুপের সদস্যরা আনন্দে ভাসছে।

হত্যা, গুম, অপহরণ, ডাকাতি, ধর্ষণ—এমন কোনো অপরাধ নেই, যা শিবিরে ঘটছে না। কিন্তু ‘নকল আরসা’ গ্রুপের সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের ভয়ে শিবিরের সাধারণ সদস্যরা টুঁ শব্দও করতে পারে না। শিবিরের সাতটি ব্লকের প্রতিটি থেকে ২০ জন করে যুবক রয়েছে গ্রুপের সদস্য। প্রতি রাতে শিবিরে পাহারাদারদের সঙ্গে থাকে গ্রুপের গোয়েন্দা সদস্য। কোনো রোহিঙ্গা তাদের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য পাচার করলে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। এসব বিষয়ে গতকাল নয়াপাড়া শিবিরের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক কবির হোসেনের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের ধরার জন্য চেষ্টা চলছে।’

‘চোখকে বলি তুমি শুধু চেয়ে থাকবে, কানকে বলি তুমি শুধু শুনবে, আর মুখকে বলি তুমি কোনো শব্দ করবে না’—এমনই ভয়ভীতি আর নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান নুরুল আমিন। কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের এই বাসিন্দা নিতান্তই একজন সাধারণ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাপ-দাদার ভিটাবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। আক্ষেপ করে গতকাল তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গারা আত্মঘাতী এক জাতি। এখানে সামান্য বিষয় নিয়ে আমরা আমাদেরই খুন করছি। আমরাই দিনে-দুপুরে অপহরণ আর গুম করছি। আবার আমরা কাউকে এসব বলতেও পারছি না।’

বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে এসেছে খাবারদাবার নিয়ে। এমন শান্তির জায়গায়ও তাদের স্থান হচ্ছে না নিজের সম্প্রদায়ের সন্ত্রাসীদের কারণে। ভয়ে সারা দিন চুপ থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই বস্তির নির্দিষ্ট কামরায় ঢুকে পড়ে। সারা রাত কাটে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হামলার ভয় নিয়ে।

টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের বি ব্লকের বি-ওয়ান বস্তির বাসিন্দা মাস্টার দিল মোহাম্মদকে গত ১২ মার্চ রাতে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে গেছে। রাখাইনের ধুচং ময়দান এলাকার আবদুস শুকুরের ছেলে দিল মোহাম্মদ রাখাইন, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। তিনি বরাবরই নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে সোচ্চার ছিলেন। স্বদেশে ফেরার জন্য তিনি রোহিঙ্গাদের মধ্যে নীরবে সচেতনতা সৃষ্টি করছিলেন। স্বদেশে ফিরতে অনিচ্ছুক সশস্ত্র রোহিঙ্গার দল ওই রাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানের মাঝ থেকে তাঁকে ধরে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে গেছে। এখনো তাঁর কোনো খোঁজ নেই।

রোহিঙ্গা শিবিরে এমন গুম-অপহরণ আর খুনের ঘটনার তালিকা বেশ দীর্ঘ। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের নির্মমতায় শত শত রোহিঙ্গার নীরব চোখের জলে যেন ভাসছে পাহাড়ের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো।

সম্প্রতি কালের কণ্ঠে রোহিঙ্গা শিবির নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর সূত্র ধরে সুদূর সৌদি আরব থেকে আবু আহমদ নামের একজন রোহিঙ্গা গতকাল এই প্রতিবেদকের কাছে এক ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সৌদি আরবসহ অনেক দেশে দেশত্যাগী বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে। বিদেশের মাটিতে থাকা রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের শিবিরে পরিবারের লোকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। শিবিরের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

আরও খবর