সমকাল – আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারিদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায় থেকে তাদের সম্পদ বিবরণীর তথ্য সংগ্রহ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সিআইডির ইকোনমিক ক্রাইম বিভাগে পাঠাবে। এর পর আত্মসমর্পণকারীদের সম্পদের উৎস সম্পর্কে বিশদ অনুসন্ধান করবে সরকারের একাধিক সংস্থা। সেখানে কোনো গরমিল পাওয়া গেলেই ইয়াবা কারবারিদের সম্পদ জব্দ ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে দেওয়া হবে। এরই মধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী গতকাল রোববার সমকালকে বলেন, আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে মাদক কারবারিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কেউ এ সুযোগ না নিলে তার জন্য কঠোর বার্তা রয়েছে। আর দেশের অন্য এলাকার কোনো মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করতে চাইলে তারা সেই সুযোগ পাবে। এর পাশাপাশি দেশব্যাপী মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান অব্যাহত থাকবে।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, আত্মসমর্পণকারীদের সম্পদের খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। যদি তারা সম্পদের প্রকৃত হিসাব দিতে না পারেন, তাহলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে। তিনি আরও বলেন, তালিকাভুক্ত যারা এখনও আত্মসমর্পণ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। দেখামাত্র গ্রেফতার করা হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার বলেন, আত্মসমর্পণকারী কেউ কোনো হুমকি-ধমকি দিচ্ছে- এ ধরনের কোনো তথ্য তাদের জানা নেই। তাদের বিরুদ্ধে অতীতে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে যেসব মামলা রয়েছে, তা তাদেরকেই আইনিভাবে মোকাবেলা করতে হবে। আর আত্মসমর্পণের পর তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে কীভাবে সহায়তা করা যায়, তা রাষ্ট্র আইনি পথে ভেবে দেখছে। শুধু সেই মামলার ব্যাপারে তারা রাষ্ট্রের সহায়তা পাবেন।
গত শনিবার কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির চার ভাই ও আত্মীয়সহ ১০২ ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্যে ৩০ শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছেন। তবে তালিকাভুক্ত অনেকে এখনও আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছেন। তারা দেশ-বিদেশে পালিয়ে আছেন। আবার তালিকার কয়েকজনকে প্রকাশ্যে ঘুরতে দেখা গেছে।
সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে জানায়, প্রথম দফায় যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের অধিকাংশ সম্পদশালী। তাই আত্মসমর্পণের পর তাদের অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নিয়ে সংশ্নিষ্টরা কোনো কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করছেন না। মূলত অতীতের ভুল বুঝে তারা যদি আত্মসমর্পণের পর মাদকবিরোধী সামাজিক কোনো ক্যাম্পেইনে অংশ নিতে চায়, তাহলে তাদের স্বাগত জানানো হবে।
পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, নতুনভাবে যদি কেউ আবার আত্মসমর্পণ করতে চায়, তাহলে তা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে স্বাগত জানানো হবে। তবে আত্মসমর্পণের পর কারাগার থেকে মুক্তি মেলার পর নতুনভাবে কেউ মাদক ব্যবসায় জড়ালে তাদের ব্যাপারে ‘কঠোর শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘সরকার মাদক নির্মূলে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কে কার ভাই, কে কার আত্মীয়-স্বজন সেটা দেখার সুযোগ নেই। যারাই মাদকের সঙ্গে জড়িত, তাদের কারও ছাড় নেই। কোনো ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারে। সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।
আত্মগোপনে যারা : পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে ৭৩ মাদকের গডফাদারের মধ্যে ৩০ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। এ ছাড়া এই তালিকার ছয়জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে দু’জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক এবং একজন নিখোঁজ হয়েছেন। বাকিরা এখনও দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এখনও তালিকার যারা আত্মসমর্পণ করেননি, তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি ও তার ভাই মজিবুর রহমান, নির্মল ধর, রোহিঙ্গা মোহাম্মদ আলম, ডাকাত আবদুল হাকিম, সাইফুল, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, মোহাম্মদ জাফর আহমদ, মোহাম্মদ জাফর, সাইফুল করিম, মোহাম্মদ শাহজান, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ রফিক, মোহাম্মদ আজিজ, নুর কামাল, মোহাম্মদ মুজিব, আবদুর রহমান, রাশেদ মাহামুদ আলী, মাহাবুব মোর্শেদ, এসকে আনোয়ার, আবুল হোসেন, আবদুল হামিদ, মোহাম্মদ হেলাল, মোহাম্মদ হুমায়ুন প্রমুখ। এদিকে, শনিবার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেও শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের কয়েকজনকে প্রকাশ্যে দেখা গেছে। আত্মসমর্পণ না করলেও তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ তালিকায় ছিলেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান শাহজান মিয়া, জাফর আহমদ, হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান এসকে আনোয়ার ও বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন ও ইউপি সদস্য মোহাম্মদ ইউনুছ। তবে গতকাল তাদের টেকনাফে দেখা যায়নি। এলাকাবাসী জানান, আতঙ্ক ও ভয়ে তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন।
কক্সবাজার কারাগারে ভিড় : আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারিদের ইয়াবা ও অস্ত্র মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কক্সবাজারের কারাগারে পাঠানো রয়েছে। তাদের দেখতে রোববার সকাল থেকে স্বজনরা ভিড় করেন। কারাগারে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা বলেন, টেকনাফ থেকে অনেক মানুষ কারাবন্দিদের দেখতে এসেছেন। একদিনে টেকনাফ থেকে আগে কখনও এত মানুষ কারাগারে বন্দিদের দেখতে আসেনি।
ইয়াবা কি বন্ধ হবে : গতকাল টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ। অনেকে এমন প্রশ্ন তুলেছেন- আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় কি ইয়াবা বন্ধ হবে? টেকনাফবাসীর মুখে নানা মন্তব্য শোনা গেছে। তাদের মতে, এখানেই কি শেষ? পরবর্তী পদক্ষেপ কী হচ্ছে? তবে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে একধরনের স্বস্তি ফিরেছে। তাদের মতে, বাকিদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে এ পথে আসা উচিত বা সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-