আত্মসমর্পণ যেন মাদক ব্যবসায়ীদের বাঁচিয়ে দেয়ার কৌশল না হয়

প্রভাষ আমিন : সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালায়। এসব অভিযানে ভালো ফলও পাওয়া যায়। গত বছরের ৪ মে থেকে দেশজুড়ে চলছে মাদকের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান। এটি দেশ ও জাতির জন্য সবচেয়ে দরকারি অভিযান। মাদক ধ্বংস করে দেয় আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই প্রতিশোধ হিসেবে মাদক, মাদক ব্যবসা এবং মাদক ব্যবসায়ীদের ধ্বংস করে দিতে হবে। তবে ধ্বংস করে দেয়া মানে বিনা বিচারে মেরে ফেলা নয়। মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত ৩০০ জন ক্রসফায়ারে মারা গেছে। তারা অধিকাংশই সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ী হোক আর যাই হোক, বিনা বিচারে কাউকে মেরে ফেলা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বিনা বিচারে মেরে ফেলার অংশটুকু বাদ দিলে মাদক বিরোধী অভিযানের ঘোরতর সমর্থক আমি। সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। আমরা চাই মাদক সম্পূর্ণ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলুক।

টেকনাফের নাম বাংলাদেশের সবাই জানে। বাংলাদেশের মানচিত্রের একদম নিচের বিন্দুটি টেকনাফ, আর একদম ওপরেরটি তেতুলিয়া। তাই বাংলাদেশ বোঝাতে আমরা জলি টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। কিন্তু ইদানিং টেকনাফ মানেই ইয়াবা। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে টেকনাফের অনেকেরই আঙুল ফুলে বটগাছ গজিয়েছে। কয়েকবছর আগে যে ছিলো পথের ফকির, এখন তার সুরম্য ভবন। অবশ্য মাদক বিরোধী অভিযান শুরুর পর জিন-ভুতেরা এসে সেই সুরম্য অট্টালিকার অনেকগুলো ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। জিন-ভুত বলছি, কারণ পুলিশ ভাঙ্গলেও তা স্বীকার করেনি। টেকনাফে এখন আত্মসমর্পণের উদ্যোগ। আজ শনিবার সকালে টেকনাফ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ১২০ জন মাদক ব্যবসায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। খুবই ভালো উদ্যোগ। কোনো অপরাধী ভুল বুঝে আত্মসমর্পণ করতে এলে অবশ্যই তাদের স্বাগত জানানো উচিত, তাদের শোধরানোর সুযোগ দেয়া উচিত। তবে টেকনাফে মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন ও সংশয় রয়ে গেছে। প্রথম কথা হলো, যে ১২০ জন মাদক ব্যবসায়ী আজ আত্মসমর্পণ করছে, তারা কি নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে শোধরানোর সুযোগ পেতে আত্মসমর্পণ করছে; নাকি নিজেদের জীবন ও সম্পদ বাঁচাতে করছে। কারণ অভিযান শুরুর পর কক্সবাজার-টেকনাফেই ক্রসফায়ারে মারা গেছে ৪৪ জন। তাই জানের ভয়ে অনেকে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে পুলিশ লাইনকে। আজ যারা আত্মসমর্পণ করছে, তারা অনেকদিন ধরেই পুলিশ হেফাজতে আছে। এখন প্রশ্ন হলো আত্মসমর্পণকারীদের অর্জিত সম্পদের কী হবে, তাদের অপরাধের কী সাজা হবে? নাকি তারা আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজেদের ক্লিন করে, কদিন পর জামিনে বেরিয়ে আগের সম্পদ ভোগ করতে পারবে? সুযোগ বুঝে আবার ইয়াবা ব্যবসা শুরু করতে পারবে?

আত্মসমর্পণ করতে যাওয়া ১২০ জন ছাড়া বাকি ইয়াবা কারবারীদের কী হবে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইয়াবা ব্যবসায়ী আবদুর রহমান বদিকে নিয়ে। তিনি কিন্তু আত্মসমর্পণ করছেন না। বরং আত্মসমর্পণকে নাটক মনে হয়, যখন জানি এই মূল সমন্বয়কারী বদী নিজেই। শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার মত কাহিনী। টেকনাফে এখন ইয়াবার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠ আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাংসদ। তিনি যে অপরাধী সেটা তো আওয়ামী লীগই প্রমাণ করেছে। তাই তো গত নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন পাননি, পেয়েছেন তার স্ত্রী। দলের মনোনয়ন না পাওয়ার মতো অপরাধ করলেও তাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে না। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, তিনি আত্মসমর্পণ করছেন না, তার বাড়ি কোনো জিন ভাঙ্গেনি, তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাইলে, সেটা এক নাম্বার থেকেই করতে হয়। পালের গোদা হাওয়া লাগিয়ে ঘুরবে, আর খুচরা ব্যবসায়ী ক্রসফায়ারে বা সারেন্ডার করবে; এটা কেমন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড? পত্রিকায় দেখলাম রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই ছাড় পাচ্ছেন। তবে বদি আত্মসমর্পণ না করলেও তার ৪ ভাইসহ ১২ নিকটাত্মীয় আজ আত্মসমর্পণন করছেন। মনে হচ্ছে, বদির ১৪ গোষ্ঠির পেশাই ইয়াবা।

শুরুতেই বলেছ, আমি মাদকবিরোধী অভিযানের ঘোরতর সমর্থক। আমি খালি চাই, অভিযানটা আইনের আওতায় চলুক। ক্রসফায়ারের নামে যেন কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করা না হয়। সবাই যেন আইনের সমান সুযোগ পায়। রাজনৈতিক পরিচয় যেন কাউকে বাঁচিয়ে না দেয়। আত্মসমর্পণ যেন আইওয়াশ না হয়, যেন মাদক ব্যবসায়ীদের বাঁচিয়ে দেয়ার কৌশন না হয়। আর শেষ কথা হলো, যতোদিন দেশ মাদকমুক্ত না হয়, ততোদিন যেন এ অভিযান চালু থাকে।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

আরও খবর