নিরাপত্তা-বেষ্টিত কক্সবাজার পুলিশ লাইন্সের ভেতরে রয়েছে দুতলার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এটিই এখন জেলার ৬৩ অভিযুক্ত ইয়াবা গডফাদার ও ব্যবসায়ীর ‘নিরাপদ নিবাস’।
সরকারের তালিকায় থাকা দেশের ৭৩ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্তত ২৪ জন এখানে রয়েছেন বলে জানান কক্সবাজারের একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা।
গত বছরের মে মাসে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এরা পলাতক ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দুই থেকে ১৬টি করে মামলা রয়েছে। কিন্তু, গত সপ্তাহে আত্মসমর্পণের পর এখন তারা বেশ নিশ্চিন্তেই রয়েছেন।
এই ‘ইয়াবা সম্রাটদের’ মধ্যে রয়েছেন নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গত সংসদের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি’র তিন ভাই। দেশের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে সরকারের বিভিন্ন তালিকায় তাদের নাম রয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে দ্য ডেইলি স্টারের একজন সংবাদদাতা সেই ‘নিরাপদ নিবাস’-এর ভেতরটি এক ঝলক দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।
ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা যায়, সেখানে কেউ কেউ খোশগল্প করছেন। কেউ আবার এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছেন। পরিবার থেকে পাঠানো সান্ধ্যকালীন নাস্তাও খেতে দেখা গেছে কাউকে। তবে সবাইকে দেখে মনে হয়েছে তারা সেখানে নিশ্চিন্তেই রয়েছেন সেখানে।
সাদাপোশাকে দুজন কনস্টেবল প্রবেশপথটি পাহারা দিচ্ছিলেন। পেছনের খোলা জায়গায় ছিলেন আরও তিনজন। ১২শ’ স্কয়ার ফুটের এই দালানের দুই তলায় রয়েছে ১২টি কক্ষে।
‘নিরাপদ নিবাসের’ একজন বলেন, “এখানে আমরা আসলেই ভালো আছি। পরিবার থেকে আসা খাবার সবাই মিলে ভাগ করে খাই। পুলিশ সদস্যরা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছেন।”
বদি এখনো মুক্ত থাকলেও তার তিন ভাই আত্মসমর্পণ করেছেন। তারা হলেন আব্দুল আমিন, মোহাম্মদ শফিক এবং ফয়সাল রহমান। সূত্র জানায়, তারা সম্প্রতি দুবাই থেকে বাড়ি ফিরেছেন আত্মসমর্পণ করার জন্যে।
বদির এক ভাগ্নে শাহেদুর রহমান নিপু-ও এই ‘নিরাপদ নিবাসে’ রয়েছেন। দেশের পাঁচটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বদির নাম এসেছে মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। কিন্তু, তিনি কখনোই কোনো অভিযানের মুখে পড়েননি।
সংস্থাগুলোর তালিকায় বদির বিভিন্ন আত্মীয় ও সহযোগীর নাম রয়েছে। যেমন, তার দুই ভাই আব্দুল শুক্কুর এবং মুজিবুর রহমান। তার সৎভাই আব্দুল আমিন ও ফয়সাল, শ্যালক শাহেদ কামাল এবং চাচাতো ভাই হাসান রাসেল।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বদি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন। কেননা, নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে তার নাম আবারও তালিকার শীর্ষে আসে। তবে, দল থেকে বদির স্ত্রী শাহীন আকতার চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি নির্বাচনে অংশ নেন কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ আসন থেকে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এই এলাকাকে ধরা হয় ইয়াবা চোরাচালানের প্রবেশপথ হিসেবে। কেননা, মূলত মিয়ানমার থেকেই এই মাদক এদেশে প্রবেশ করে।
তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। মাদকব্যবসায়ীরা আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে নিরাপদ জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
যেভাবে শুরু হলো এই প্রক্রিয়া
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি মহেশখালীতে কয়েকজন ডাকাত আত্মসমর্পণ করায় স্থানীয় প্রশাসন অনুপ্রাণিত হয়ে এই আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া হাতে নেন। এরপর, চলতি মাসের মাঝামাঝি ‘ইয়াবা গডফাদাররা’ একে একে আত্মসমর্পণ করে ‘নিরাপদ নিবাসে’ আসতে শুরু করেন।
সূত্র আরও জানান, গত নভেম্বরে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক পুলিশ প্রশাসনকে বলেন যে সন্দেহভাজন মাদকব্যবসায়ীরা আত্মসমর্পণ করতে চান।
তখন স্থানীয় পুলিশ এই প্রস্তাব নিয়ে যোগাযোগ করে সদরদপ্তরে। এরপর, সদরদপ্তর থেকে বিষয়টির আইনগত দিকসহ বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
সূত্র মতে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে বদির সঙ্গে বৈঠক করে পুলিশ। তিনি এতে সমর্থন দিলে ‘ইয়াবা ব্যবসায়ীরা’ একে একে আত্মসমর্পণ করার আগ্রহ দেখান।
বৈঠকের পর বদি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আত্মসমর্পণের বিষয়ে কথা বলেন। তিনি তাদের নিরাপত্তার কথা বুঝিয়ে বলেন।
গতকাল বদির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন যে তিনি সবসময়েই ইয়াবা ও সবধরনের মাদকের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু, কিছু মানুষ ব্যক্তিগত সুবিধা পাওয়ার জন্যে তার নাম তালিকায় দিয়েছেন।
তার দাবি, “এখন আমি যখন আবার মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করলাম তখন কিছু মানুষ আবার এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করলো।”
তিনি অভিযোগ করে বলেন যে কায়েমিস্বার্থবাদী একদল মানুষ তার এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এখনো কাজ করে যাচ্ছে।
“আইনের চোখে সবাই সমান,” উল্লেখ করে বদি বলেন, “আমি আমার পরিবারের সদস্যসহ মাদকব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আত্মসমর্পণ করার অনুরোধ করছি।”
এদিকে, পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে আরও কয়েক ডজন মাদকব্যবসায়ী আগামী মাসের মাঝামাঝি আত্মসমর্পণ করবে।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, মাদকব্যবসায়ীরা সরকারের কাছ থেকে একটি সুযোগ চায়। কিছু শর্তের মধ্য দিয়ে সরকার তাদেরকে সেই সুযোগ দিতে রাজি হয়।
ইয়াবা বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা যে টাকা উপার্জন করেছেন সে বিষয়ে কী হবে?- এমন প্রশ্নে জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন শীর্ষ কর্তাব্যক্তি বলেন, তাদের সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্যে তারা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে চিঠি লিখবে।
এরপর, দুদক এবং এনবিআর এ বিষয়ে তাদের তদন্ত চালানোর কাজ হাতে নিবে।- ডেইলি স্টার
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-