কক্সবাজারে দিন দিন বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েই চলেছে

শাহীন মাহমুদ রাসেল :

কক্সবাজারে দিন দিন মানুষের মাঝে পারিবারিক বন্ধন হালকা হয়ে পড়ছে। সঙ্গীহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। গত এক দশকে কক্সবাজারে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুন। আর সঙ্গীদের থেকে আলাদা থাকার প্রবণতা বেড়েছে তিনগুন। সম্প্রতি এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে শহরের মতো অন্যান্য উপজেলায় নারীরা বিচ্ছেদের আবেদন করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন। কোর্ট, কাজী অফিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাথে কথা বলে বিগত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কক্সবাজারের শহর এবং প্রতিটি গ্রামগুলোতে প্রতি বছরই বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বিচ্ছেদ বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সন্দেহ, যৌতুক দাবি, সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, স্বামী-স্ত্রীর জীবন-যাপনে অমিল, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইউনিয়ন পরিষদ এবং কাজী অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আর বলেন, নারীর পেশাগত উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আগের চেয়ে বেশি সচেতন। নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে এখন আর আপস করছেন না বরং অশান্তি এড়াতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করছেন।

জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, বিবাহবিচ্ছেদের জন্য ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আবেদন করছেন। রেজা নামের একজন আইনজীবী বলেন, নৈতিক স্খলনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজে এখন বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ইয়াবা আসক্ত স্বামী ভরণ-পোষণ দিতে না পারাই বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। আর প্রবাসী বাঙালি, যাদের স্ত্রী তাদের থেকে দূরে থাকেন। তাদের ঘিরে এই প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়। একই সঙ্গে বাড়ে সন্দেহ প্রবণতা। যা পরবর্তীতে বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু কক্সবাজার পৌরসভা এলাকাতেই গড়ে প্রতিদিন ১০টির বেশি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে। পৌরসভার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার পৌর এলাকায় বিচ্ছেদের নোটিস পাঠানো হয়েছে ১৪ হাজার ৯১২টি। এর মধ্যে পুরুষের পাঠানো নোটিসের সংখ্যা আট হাজার ৯৬টি এবং নারীর ৬ হাজার ৮১৬টি। অর্থাৎ নারীরা পুরুষের প্রায় সমান বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। শহরের বাইরে বিভিন্ন উপজেলায় বর্তমানে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রেও আবেদনকারীদের মধ্যে এগিয়ে নারী। টেকনাফে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে টেকনাফ উপজেলায় মোট বিচ্ছেদ হয়েছে ছয় হাজার ৫৪৭টি। টেকনাফে প্রতিবছরই বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেখানেও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে। অন্যান্য উপজেলার মতো সদর,রামু, মহেশখালীতেও বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের হিড়িক পড়েছে। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারের নারীরা বিচ্ছেদের আবেদন বেশি করছেন। এমনকি বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে কুতুবদিয়াতেও। প্রতিদিন এই উপজেলায় গড়ে ৫টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে।

কক্সবাজার জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে বাকী উপজেলাতেও আশঙ্কাজনকহারে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর শহরাঞ্চলে এই বিচ্ছেদের হার আরও বেশি। এক্ষেত্রেও বিচ্ছেদের দিক দিয়ে এগিয়ে নারীরা। কারণ একটাই ইয়াবা।

কক্সবাজার রেজিস্ট্রার অফিসের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বিচ্ছেদের ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃদ্ধি পাওয়ায় শালিসি বোর্ডের কর্মকর্তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোর্টের কর্মকর্তারা জানান, সমাজের সব শ্রেণির নারীরাই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করছেন। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে আসক্ত নারীদের কেউ কেউ আবার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করেন। তারা বলেন, মাত্র ২ শতাংশ দম্পতি আমাদের কাছে শালিসি বৈঠকে আসেন।

আর নারীদের তালাক দেওয়ার হার পুরুষের চেয়ে বেশি বলেও তারা স্বীকার করেন। তবে সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজ বলেই বিচ্ছেদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, একটি পরিবার ভেঙে গেলে শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সম্পর্কে ফাটল ধরে না, তাদের সন্তানদের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।

কক্সবাজার নিকাহ রেজিস্ট্রাররা জানান, জেলায় প্রতি বছরই বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শালিসের মাধ্যমে সংসার টিকছে এমন হার খুবই কম। নিয়ম অনুযায়ী কাজী অফিসে তালাকের আবেদন জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ দুই পক্ষকে বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য বা সমঝোতার জন্য তিন মাস সময় দেয়। তালাকের আবেদন করা হলে শালিসের মাধ্যমে সংসার টিকছে এমন হারও কম। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বিচ্ছেদের আবেদন পাওয়ার পর দুই পক্ষকে প্রতি মাসে শুনানির জন্য ডাকা হলেও ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই এই শুনানির জন্য কোনো পক্ষই ইউনিয়ন পরিষদে যায় না।

আরও খবর