একজন নারীই পারেন উখিয়া টেকনাফের দৃশ্যপট বদলে দিতে

ডেস্ক রিপোর্ট- একবিংশ শতাব্দির কক্সবাজারে এক অভিশাপের নাম ইয়াবা। মরণঘাতক এই মাদকের কবলে পড়ে এখন দেশব্যাপী আলোচিত-সমালোচিত বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের দুই উপজেলা উখিয়া এবং টেকনাফ। অভিযোগ রয়েছে, স্বল্প সময়ে কোটিপতি হওয়ার সুযোগ নিতে ইতোমধ্যেই উপজেলা দুইটির বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা পাচারে। পুরুষের পাশাপাশি নারী এমনকি শিশুরাও রয়েছে এই তালিকায়।

এদিকে ইয়াবার কলঙ্ক নিয়েই মার্চে অনুষ্ঠিতব্য উপজেলা নির্বাচনে ভোট দেবেন উখিয়া এবং টেকনাফ উপজেলার মানুষ। উপজেলা দু’টির বাসিন্দারা অন্তত এ নির্বাচনে ইয়াবা সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের এড়িয়ে চলতে চাচ্ছেন। ইয়াবায় জড়িত লোকজনই যে কোন প্রকারে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আশ্রয়ে থাকে। ইয়াবার কালো টাকায় বড় রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পেতে তারা হয়ে পড়েন মরিয়া। ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি সীমান্ত জনপদে ইয়াবা পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের এড়িয়ে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় দেশপ্রেমিক এবং ইমেজধারি ব্যক্তিদের প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেয় তাহলে ইয়াবার বদনাম থেকে এলাকাবাসীর অনেকটাই রেহাই মিলবে।
ইয়াবার পরিস্থিতির সবচেয়ে ভয়াবহতম শিকার উখিয়া এবং টেকনাফের সাধারণ মানুষ। যাঁদের সঙ্গে ইয়াবা নামক মাদকের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। এলাকার বাসিন্দারা অনেক সময় দুঃখ করে বলছেন- ইয়াবার কারণে উপজেলা দুইটির অনেক প্রাপ্ত বয়স্কা শিক্ষিত নারী বিয়ের উপযুক্ততা হারাচ্ছে। এমনও রয়েছে, পাত্রপক্ষ স্থায়ী ঠিকানা টেকনাফ শুনলেই বিয়ের ব্যাপারে না সূচক জবাব দেয়। ফলে নিজ কন্যা সন্তানকে সুপাত্রে হস্তান্তর করতে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের। একই অবস্থা পুরুষের ক্ষেত্রেও। ছেলের বাড়ি টেকনাফ শুনলেই সম্ভাব্য কনে পক্ষ মনে করেন, ছেলে হয়তো ইয়াবা পাচারে জড়িত। এই ভয়ে নিজ মেয়ের টেকনাফের কোন ছেলের বর হিসেবে দেখতে চান না মেয়ের মা-বাবা। বাস্তবে পরিস্থিতিটা এরকমই।
এক সময় যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো নারায়নগঞ্জ জেলার মানুষদের। নারায়নগঞ্জে ছিলো দেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয়। ফলে জেলাটির ব্যাপারে সারাদেশের মানুষের বিরূপ ধারণা ছিলো। ফলে নারায়নগঞ্জ জেলার মানুষদের সঙ্গে কেউ বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ দেখাতেন না। যদিও নারায়নগঞ্জ তৎকালীন সময়েও দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিলো। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি আর নেই। পতিতালয় উচ্ছেদের পর থেকেই নারায়নগঞ্জের মানুষের কদর বেড়েছে দেশব্যাপী। স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছেন তাঁরা।

এই মরণনেশা ইয়াবা পাচার রোধে যাঁদের কার্যকর ভূমিকা থাকার কথা এক সময় তাঁরা নিজেরাও জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা পাচারে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। যাতে রয়েছে উখিয়া এবং টেকনাফ উপজেলার বিপুল সংখ্যক জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক নেতার নাম। এমনকি নির্বাচিত সংসদ-সদস্য (বর্তমানে সাবেক) পর্যন্ত রয়েছেন এই তালিকায়। ফলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনীতিকদের কারনেই উল্লিখিত উপজেলা দুইটিতে ইয়াবা পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে অভিযোগ উঠে।

বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার নির্বিঘœ করতে নাফ নদ সংলগ্ন মায়ানমারে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ইয়াবা কারখানা। যেখানে প্রতিদিন তৈরি করা হচ্ছে বিপুল সংখ্যক ইয়াবা। পরবর্তীতে এদেশের এজেন্টদের মাধ্যমে যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো হয়। যেখান থেকে বিভিন্ন পাচারকারীর মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয় ইয়াবা। এমনও অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের কোন কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে গোপনে মিয়ানমারের সেইসব ইয়াবা কারখানায় শেয়ারে কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন।

সীমান্তের কারখানার বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে মায়ানমারকে অবহিত করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)এবং মায়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি’র মধ্যে বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত হয় দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। এসব বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিজিপির হাতে তুলে দেয়া হয় বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন মায়ানমারের অভ্যন্তরে স্থাপিত ইয়াবা কারখানার তালিকা। বিজিবি তালিকা গ্রহণ করলেও সবসময়ই বাংলাদেশের অভিযোগ অস্বীকার করে চলে। ফলে বাংলাদেশের একার পক্ষে ইয়াবা পাচার বন্ধতো দূরে থাক নিয়ন্ত্রণ করাই দুরূহ হয়ে পড়েছে।

ইয়াবার কারণে টেকনাফের সাধারণ মানুষের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে তা কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে বর্ণনা করেছেন উপজেলাটির শীর্ষ পর্যায়ের এক রাজনৈতিক নেতা। একটি গণমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, টেকনাফের মানুষ শুনলে ঢাকার হোটেলগুলোতে তাঁদের কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়না। এ ছাড়া পদে পদে হেনস্থার শিকারতো রয়েছেই।

এই পরিস্থিতি থেকে উখিয়া এবং টেকনাফের মানুষ মুক্তি চান তা অনুধাবন করা যায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ইয়াবা পাচারের কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে পড়ায় একজন সংসদ-সদস্যকে তাঁর দল মনোনয়ন দেয়নি। এতে এলাকাটির মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ করার কথা থাকলেও তাঁরা ছিলেন নিশ্চুপ। অনেকেই নীরবে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

বর্তমানে সেই আলোচিত সংসদ-সদস্যের স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর স্ত্রী। নারী হওয়ার কারনে তাঁর প্রতি এলাকার মানুষের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ফলে সবাই আশার বাণী দেখছেন একজন নারী হিসেবে নিজ এলাকার পাশাপাশি দেশে ইয়াবা পাচার রোধে তাঁর ভূমিকা হবে কার্যকর। তিনি ইয়াবার বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থে কঠোর অবস্থান নিলেই চুনোপুটিরা নিজেদের গুটিয়ে নেবে। তখন দেশ হবে ইয়াবামুক্ত।

সচেতন মহলের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নারী হয়ে এক সময়ের দুর্নীতিগ্রস্থ বাংলাদেশের চেহারাটাই বদলে দিয়েছেন। বদলে দিয়েছেন দারিদ্রতায় জর্জরিত এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকও। অনুরুপ উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনে একজন নারীর দৃঢ়তার কারনে যদি পরিস্থিতি সত্যি পাল্টে যায় তখন দেশে-বিদেশেও বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে রিতীমত হৈচৈ পড়ে যাবে। তখন বাড়বে দেশের ভাবমুর্তিও। ইতিমধ্যেই আসনটির নব নির্বাচিত এমপি মিসেস শাহিন আকতার প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রীর সাথে দেখা করে সীমান্তের উপজেলা দুটিকে ইয়াবামুক্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্তও করেছেন। দেশবাসী যাকে দেখছে অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে।

আরও খবর