গড়ে উঠছে রোহিঙ্গা বসতি

হুমকির মুখে ইনানীর প্রস্তাবিত জাতীয় উদ্যান

রফিক উদ্দিন বাবুল,উখিয়া :

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটন স্পট উখিয়ার উপকূলীয় এলাকা সাগর পাহাড় প্রকৃতির নৈসর্গিক মেলবন্ধন ইনানীর ১০ হাজার হেক্টর বনভূমি নিয়ে গড়ে তোলা প্রস্তাবিত জাতীয় উদ্যান এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

জাতীয় উদ্যানের জায়গা দখল করে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর প্রভাব পড়েছে। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বন্য পশুপ্রাণী ও জীববৈচিত্র।

প্রস্তাবিত জাতীয় উদ্যান রক্ষার্থে অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে সরকারের সুদুর প্রসারী উদ্যোগ ইনানী জাতীয় উদ্যান প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার আশংকা করছে এলাকার পরিবেশবাদী সচেতন মহল।

ইনানী রক্ষিত বনাঞ্চল সহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, ইনানীর ১০ হাজার হেক্টর বনভূমিকে পর্যটন শিল্পে রূপান্তর করে সরকারের প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ দেশি বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মহান উদ্যোগ নিয়ে জাতীয় উদ্যান হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি প্রাপ্তির জন্য ইতিপূর্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেশ কয়েকবার আবেদন আকারে পরিপত্র প্রেরণ করা হলেও কার্যথ কোন সুফল পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ মহি উদ্দিন প্রস্তাবিত জাতীয় উদ্যান পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করে এ বনটিকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে খুব সহসায় অনুমোদন দেওয়ার আশ্বস্ত করলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। উপরোন্তু মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গা বসতির পরিধি দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে হোয়াইক্যং, পালংখালী, রাজাপালং, ইনানীর জাতীয় উদ্যানের বেশ কিছু অংশ রোহিঙ্গারা দখল করে তাদের আবাসস্থল গড়ে তুলেছে।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও ইনানী বন রক্ষা সহায়ক কমিটির সদস্য আব্দুল মান্নান জানান, রোহিঙ্গা ছাড়াও টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ও মহেশখালীর প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার ইনানী জাতীয় উদ্যানের জমি দখল করে সেখানে বাড়িঘর তৈরি করেছে। পাহাড় ঢিলা কর্তন করে ফসলী জমি তৈরি করছে। মানবজাতির অবাধ বিতরণের ফলে সেখানে আশ্রিত বনপশু প্রাণী তাদের আবাসস্থল হারিয়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে।

জালিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী জানান, ২০০৮ সাল পর্যন্ত ইনানীর ১৯ হাজার হেক্টর বনভূমির ৮০শতাংশ বন সম্পদ উজাড় হয়ে যাওয়ার ফলে বন্য পশুপ্রাণী আবাস স্থল হারিয়ে লোকালয়ে চলে আসতে শুরু করে।

বনভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে বসতি স্থাপন ও কৃষি জমিতে রূপান্তর সহ নির্বিচারে পাহাড় কেটে মাটি পাচার ও বন্যপশুপ্রাণী শিকার করার ফলে জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়।

তিনি বলেন, এখানে বন বিভাগ থাকলেও কার্যথ তাদের ভূমিকা রহস্যজনক। বর্তমানে উক্ত বনভূমিতে সৃজিত বন বাগান রোহিঙ্গারা জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করায় জাতীয় উদ্যানের অভয়ারণ্য দিন দিন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ইনানী বনরেঞ্জ কর্মকর্তা ইব্রাহিম হোসেন জানান, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ছত্রছায়ায় জাতীয় উদ্যানের আওতাধীন বনভূমি দখল করে স্থাপনা তৈরির কথা স্বীকার করে বলেন, এসমস্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ পাহাড় কেটে মাটি পাচার প্রতিরোধ করতে গেলে মুঠোফোনে হুমকি প্রদর্শন করা হয়। যে কারণে বনের ভিতর অনৈতিকতা বন্ধ করা বনকর্মীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

২০০৯ সালে স্থানীয় বনবিভাগ, বেসরকারি এনজিও সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশন, স্থানীয় এনজিও সংস্থা শেড যৌথ উদ্যোগে এলাকার বন নির্ভরশীল বিশাল জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে “বন বাঁচায় আমাদেরকে, আমরা বাচাঁবো বনকে” এ স্লোগানকে সামনে রেখে ইনানীর বন উন্নয়নে একটি বন রক্ষা কমিটি গঠন করা হলেও বর্তমানে ইনানী বন রক্ষা সহায়ক কমিটির সদস্যরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। যার ফলে রোহিঙ্গারা ইনানীর বনে হানা দিয়ে গাছগাছালি কেটে নিয়ে যাচ্ছে।

ইনানীর বন বা জাতীয় উদ্যান কে রক্ষা করতে হলে ইনানীর প্রস্তাবিত ১০ হাজার হেক্টর বনভূমি রক্ষায় নিয়োজিত বন রক্ষা সহায়ক কমিটির সদস্যদের আরো কঠোর নির্দেশ দিয়ে যথাযথ দায়িত্ব পালনে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।

ইনানী রক্ষিত বনাঞ্চল সহায়ক কমিটির সমন্বয়কারী শাহদাত হোসেন জানান, ইনানী বন সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারি বননির্ভরশীল প্রায় ২৪টি গ্রামভিত্তিক বন সংরক্ষণ ফোরাম গঠন করা হয়। তাদেরকে ৪০ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা এককালীন সহায়তা প্রদান করে বিভিন্ন পেশায় সম্পৃক্ত করা হলে তারা বাঁশ, গাছ, পশু প্রাণী শিকার বন্ধ করে নিজেরাই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ে।

এতে বনের উপর চাপ কমে যায় বলে ওই কর্মকর্তা স্বীকার করে বলেন, ইনানীর ন্যাড়া বনে গাছ-গাছালি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বনায়নে রূপান্তর হয়েছে। যা জাতীয় উদ্যানে স্বীকৃতির দ্বার প্রান্তে।

এমতাবস্থায় জাতীয় উদ্যানের জমিজমা দখল ,পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ, সৃজিত বন বাগানের গাছ কেটে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হলে অস্থিত্ব সংকটে পড়বে প্রস্তাবিত এ জাতীয় উদ্যানটি।

মনখালী রক্ষিত বনাঞ্চল সহায়ক কমিটির সভাপতি নুরুল আবছার জানান, স্থানীয় বনবিভাগের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ইনানীর বন থেকে কাঠ পাচার অব্যাহত রয়েছে। পাহাড় কেটে মাটি পাচারের ফলে জাতীয় উদ্যান কর্মসূচী হুমকির মুখে পড়েছে।

ইনানী রক্ষিত বনাঞ্চল সহায়ক কমিটির ফিল্ড সুপার ভাইজার আবু সরওয়ার জানান, ইনানীর বনকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে অনুমোদন দেওয়া হলে বন বিভাগের কর্তৃত্ব থাকে না।
বছর বছর বন বাগান সৃজনের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়াও বন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনৈতিক ফায়দা থেকে বনকর্মীরা বঞ্চিত হবে।

যার প্রেক্ষিতে জাতীয় উদ্যান অনুমোদনে তারা বেঁেক বসেছে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। জাতীয় উদ্যান বাস্তবায়নে যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ইনানীর ১০ হাজার হেক্টর বনভূমিকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে অনুমোদন দিতে গড়িমসি করার নেপথ্যে বনবিভাগের কঠোর বিরোধীতা রয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।

আরও খবর