কক্সবাজারে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে অসহায় পর্যটক ও স্থানীয়রা

বিশেষ প্রতিনিধি :

ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে অসহায় কক্সবাজারের পর্যটক ও স্থানীয়রা
ছিনতাইয়ের হটস্পটে পরিণত হয়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। প্রতিদিন শহরের কোথাও না কোথাও ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন লোকজন। রাত আর দিনে সমানভাবে চলে ছিনতাই। শহরে অব্যাহত ছিনতাইয়ের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পর্যটক ও স্থানীয়দের মাঝে। শহরের অন্তত ৩০-এর অধিক স্থানে ছিনতাইকারীদের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্য রয়েছে।

ছিনতাই চক্রের কবলে পড়ে পর্যটক ও স্থানীয় লোকজন হারাচ্ছে মোবাইল, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র। এছাড়া তাদের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র ও ছুরির আঘাতে লোকজন নিহত ও আহত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবহেলা ও উদাসীনতায় দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যার কারণে বেড়েছে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। এছাড়া সড়কে পর্যাপ্ত লাইটিং ও সিসিটিভি ব্যবস্থার অভাবে আরও বেশি সুযোগ পেয়েছে ছিনতাইকারী চক্র।

কক্সবাজার সদর থানা সূত্রে জানা গেছে, গত তিন মাসে জেলা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১১৬ জন ছিনতাইকারীকে আটক করেছে পুলিশ । এর মধ্যে মামলা দায়ের হয়েছে ৩২ জনের বিরুদ্ধে।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী ও লাবনী পয়েন্ট ছিনতাইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়াও শহরের বাস টার্মিনাল, লারপাড়া, লিংকরোড়, বিজিবি ক্যাম্প, কবিতা চত্বর, লালদিঘিপাড়, খুরুশকুল রাস্তার মাথা, গোলদিঘিপাড় ও বাজারঘাটাসহ অন্তত ৩০ স্পটে প্রতিদিন শত শত ছিনতাইকারী দাপিয়ে বেড়ায়।

গত ১৬ জানুয়ারি সকালে গোলদিঘিপাড়ে অমিতা নাথ নামের একজন নার্সের গলা থেকে চেইন ছিনতাই করে নিয়ে যায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী।

তিনি জানান, এক যুবক হঠাৎ আমার গলা থেকে চেইন টান দিয়ে নিয়ে যায়। দিন-দুপুরে ওপেন জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় প্রকাশ্যে এ ঘটনা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল।

লিংকরোড় এলাকার সাইফুল ইসলাম নামের একজন ভুক্তভোগী বলেন, কিছু দিন আগে সিএনজি গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় দু’জন যুবক পিছনে অস্ত্র ও ছুরি ধরে আমার দু’টি মোবাইল ফোন ও টাকা নিয়ে নেয়। তাদের কথামতো জিনিসপত্র না দিলে মারধর, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতে পারতো।

আরেকজন ভুক্তভোগী তাফহীমুল আনাম তোহফা বলেন, অফিস শেষ করে সিএনজি গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম, মোবাইলে কল আসায় বের করে কথা বলার সময় পিছন দিক দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক আমার মোবাইলে টান দেয়। মোবাইল হাতে শক্তভাবে ধরে থাকায় নিতে পারেনি।

ঢাকা থেকে ভ্রমণে আসা পর্যটক সমির মল্লিক বলেন, কক্সবাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যটন শহরে নিয়মিত ছিনতাই হয়, এটা খুবই উদ্বেগজনক বিষয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আমার সামনে দু’জন পর্যটকের মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায় কয়েকজন যুবক। ঘটনার সময় পথচারীরা এগিয়ে এলে ছিনতাইকারীরা দ্রুত পালিয়ে যায়।

পৌর শহরের বিভিন্ন স্পটে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। প্রতিকার না পাওয়া এবং পুলিশের হয়রানির অভিযোগ তুলে অনেকে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পর্যন্ত করছেন না।

ছিনতাই ছাড়াও কক্সবাজারে বেড়েছে অস্ত্রধারীদের দাপট, খুন ও অপহরণের পাশাপাশি দখল, চাঁদাবাজি, হামলা, ভাঙচুর এবং লুটপাটের মতো গুরুতর অপরাধ। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক দলীয় বিবেচনায় অপরাধীদের রক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় পর্যটন খাতেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পুলিশ বলছে, ৫ আগস্টের পর থেকে শহরের বিভিন্ন স্পটে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো দুর্বৃত্তরা ভেঙে ফেলেছে। গাড়িগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পারছে না। এখন পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো হয়েছে।

এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট ওসমান সরওয়ার জানান, একজন ছিনতাইকারী গ্রেফতার হওয়ার পর অল্প কিছু দিনের মধ্যে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসছে। কারাগার থেকে ফেরত আসার পর সে আরও বেশি ছিনতাই করছে। ছিনতাই প্রতিরোধে আমাদের প্রচলিত আইন সংশোধন করে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। ব্রিটিশ আমলে তৈরিকৃত ১৮৬০ সালের আইন ২০২৫ সালে এসে তেমন কাজেই আসছে না।

টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আপেল মাহমুদ বলেন, গত ১০ দিনে সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ১৪ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নষ্ট হওয়া সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো মেরামতের কাজ চলছে। যে-সব স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, সেখানে ক্যামেরা ও লাইটিং-এর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব বিষয়গুলো সমাধান হলে দ্রুতই ছিনতাই রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

আরও খবর