সীমান্তে আ’লীগ-বিএনপির চোরাচালান চক্র!

বিশেষ প্রতিবেদক :

ফাইল ছবি

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও রামুর কচ্ছপিয়া সীমান্তে রাতের আলো-আঁধারিতে বাংলাদেশে ঢুকছে শত শত গরু। এসব গরু পাহারা দেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তাদের হাতে থাকে লাঠি, মুখ কাপড়ে ঢাকা। এভাবে চোরাইপথে গরু এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করছে চোরাকারবারিরা।

পাচারকারী চক্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী জড়িত থাকলেও গত আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর যোগ দিয়েছেন বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সদস্যরাও।

জানা গেছে, মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত থাকলেও দেশটি থেকে বাংলাদেশে গরু-মহিষ চোরাচালান থামছে না।

কক্সবাজারের রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির ভালোবাসা, কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি, হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটাসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে শত শত গরু-মহিষ। গরু পাচারের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে কক্সবাজারে চলছে খুনোখুনিও। রামুতে গত ছয় মাসে এ নিয়ে দ্বন্দ্বে পাঁচটি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এ ছাড়া গরু আনতে গিয়ে সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে অনেকেই আহত হয়েছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, ডাকাত, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ব্যবসায়ী গরু চোরাচালানে জড়িত। পাহাড়ে অবস্থান করা সশস্ত্র ডাকাত ও সন্ত্রাসী দলের পাহারায় অবৈধভাবে আসা গরু সীমান্ত পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়। বেশি টাকা পাওয়ায় অপরাধীদের পাশাপাশি চোরাচালানে যোগ দিচ্ছেন শ্রমজীবী ও বেকাররাও।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করার আশ্বাসে মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিটি গরুর বিপরীতে এক হাজার টাকা করে পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে এ টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছেন কয়েকজন দালাল। এ কারণে গরু চোরাচালান থামাতে পুলিশের তেমন তৎপরতা চোখে পড়ে না।

সর্বশেষ ৮ মে রামু উপজেলার পাহাড়ি জনপদ গর্জনিয়া ইউনিয়নে আবুল কাশেম নামে এক কৃষককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর ছোট ভাই শহীদুল্লাহর দাবি, গরু পাচারে বাধা দেওয়ায় তাঁর ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। রামুতে পাঁচ হত্যাকাণ্ডের চারটিই হয়েছে গর্জনিয়া ইউনিয়নে।

এর আগে ২২ এপ্রিল গরু পাচারকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের গোলাগুলিতে বাবা-ছেলে প্রাণ হারান। গরু-মহিষ আনতে গিয়ে মিয়ানমারের ভেতর দেশটির সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে অনেকেই আহত হচ্ছেন।

মাইন বিস্ফোরণে দুই পা হারানো মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ জানান, তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। কিন্তু মিয়ানমার থেকে একটি গরু-মহিষ বাংলাদেশের মহাজনের হাতে তুলে দিলে মেলে ২ হাজার টাকা। বেশি আয় করার লোভে দুই বছর আগে গরু চোরাচালানে যোগ দেন তিনি।

রামু থানার ওসি ইমন কান্তি চৌধুরী বলেন, ওই এলাকা দিয়ে চোরাই গরু আসছে কিনা কিংবা এসব গরু থেকে পুলিশের নাম দিয়ে কেউ টাকা নিচ্ছে কিনা তা তার জানা নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে সক্রিয় রয়েছে একাধিক চোরাচালান চক্র। অন্য পণ্যের পাশাপাশি সন্ধ্যা নামলেই ফুলতলীর পথ দিয়ে চোরাই গরু আনার কাজ শুরু হয়। এর পর এশার নামাজের পর রাস্তায় লোকজন কমে গেলে প্রশাসন ও বিজিবির টহল দলের চোখ ফাঁকি দিয়ে গরুর পাল বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এসব গরু রাখা হয় বিভিন্ন পাহাড় ও খামারে। পরে বাজার ইজারাদারের কাছ থেকে রসিদ সংগ্রহ করে খামারি পরিচয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।

নেতৃত্বে ১০ প্রভাবশালী

সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, চিহ্নিত ১০ ব্যক্তির নেতৃত্বে শতাধিক চোরাকারবারি ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

  • স্থানীয়দের অভিযোগ, চোরাচালানে জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান সিরাজ শাকিল, যুবলীগ নেতা নাছির উদ্দিন সোহেল, গর্জনিয়া বাজার সমিতির সভাপতি এরশাদ উল্লাহ, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াছিন আরাফাত রিশাদ, যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম, যুবদল নেতা আনোয়ার ইসলাম রাশেল ও আজিজুল হক ভুট্টা, বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর ও নজরুল।

তবে যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন বলেন, আগে গরুর ব্যবসা করলেও লোকসানের কারণে সম্প্রতি বন্ধ করে দিয়েছেন।

গরু সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুই ধরনের লোককে কাজে নামায় চোরাকারবারি চক্র। একটি গ্রুপ গরুর সঙ্গেই থাকে; আরেকটি গ্রুপ রাস্তায় বিজিবির গতিবিধির খবর দেয়। তারা গরুপ্রতি দুই হাজার টাকা করে পায়।