আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার :
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতজুড়ে আছড়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরের বিষাক্ত ‘লাল জোয়ার’। গত দুই দিন ধরে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত অন্তত ৮০ কিলোমিটার সৈকতজুড়ে এই বিষাক্ত লাল জোয়ার এর বিষয়টি লক্ষ করছেন স্থানীয় পরিবেশকর্মী ও গবেষকরা।
বঙ্গোপসাগরে হার্মফুল এলগাল ব্লুম বা এক ধরনের ক্ষুদ্র উদ্ভিদের ব্যাপক বংশবৃদ্ধির কারণে এ ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন গবেষকরা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ও বিকেলের সামুদ্রিক জোয়ারের সময় কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা, লাবণী, কলাতলী ও দরিয়ানগর পয়েন্ট সমুদ্র সৈকত সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, কক্সবাজারের উপকূলবর্তী বঙ্গোপসাগরের পানির রঙ হলুদাভ হয়ে গেছে। এসব পানিতে প্রচুর ফেনাসহ এক ধরনের ক্ষুদ্র ও মৃত উদ্ভিদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের বিচকর্মী সুপারভাইজার মাহবুব আলম বলেন, গত দুইদিন ধরে বঙ্গোপসাগরের পানি হলুদাভ হয়ে পড়েছে। সাগরের পানিতে ফেনা জাতীয় ময়লা আবর্জনা দেখা যাচ্ছে।
দরিয়ানগর এলাকার বোট শ্রমিক আবু তাহের জানান, গত ২ দিন করে সাগরের পানির রঙ ঘোলাটে হয়ে পড়েছে। জোয়ারের সাথে দরিয়ানগর বড়ছড়া খালে প্রচুর ফেনাযুক্ত ময়লা পানি ঢুকেছে। এই খালে কেউ নামলেই চুলকানি হচ্ছে। একই তথ্য জানান উখিয়ার সোনারপাড়া এলাকার মৎস্যজীবী নুরুল কাদের। তিনি বলেন, গত দুইদিন ধরে সাগর ও রেজু নদীর পানির রঙ হলুদাভ হয়ে পড়েছে। এই দূষিত পানিতে নামলেই চুলকানিসহ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
টেকনাফের শামলাপুর সৈকতেও একই ধরনের জোয়ার আছড়ে পড়ছে বলে জানান শামলাপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এমএ মনজুর। এর আগে গত মাসের শেষ দিকেও কক্সবাজার শহরের লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্ট সৈকতে লাল জোয়ার আঁচড়ে পড়ার তথ্য জানান বোরির সমুদ্রবিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, এই ফাইটোপ্লাংক্টন ব্লুমের জন্য এস্টেরিওনেলোপসিস গ্ল্যাশিয়ালিস নামের ডায়াটমই এককভাবে দায়ী প্রজাতি। এই প্রজাতি ছাড়া অন্যকোনো ক্ষতিকর ফাইটোপ্লাংক্টন প্রজাতির অস্তিত্ব কঙবাজার বঙ্গোপসাগরে ধরা পড়েনি।
এ বিষয়ে মৎস্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সমুদ্রবিজ্ঞানী বেলাল হায়দর বলেন, এক ধরনের ক্ষতিকর ফাইটো প্লাংকটনের (উদ্ভিজ্জ অনুজীব) কারণে সাগরের পানির রঙ হলুদ বা বাদামিতে রূপান্তরিত হয়। আর সেই বাদামি বা হলুদ পানির জোয়ারই বিশ্বব্যাপী ‘লাল জোয়ার’ নামে পরিচিত। সাগরের পানিতে হার্মফুল এলগার্ল ব্লুম বা এইচএবি ঘটলেই লাল জোয়ারের সৃষ্টি হয়। এ কারণে সাগরের মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে।
আবহাওয়াগত কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাগরগুলোতে মাঝেমধ্যেই ‘লাল জোয়ার’ এর ঘটনা ঘটে বলে জানান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ড. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ক্রমাগত তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে কূলবর্তী সাগর ও নদীতে এক ধরনের ক্ষতিকর ফাইটো প্লাংকটন (উদ্ভিজ্জ অনুজীব) বিস্তার করে। হলুদ বা বাদামি রঙের হার্মফুল এলগার্ল ব্লুম বা এইচএবি অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছালেই এই লাল জোয়ারের সৃষ্টি হয়। নদীর স্বাদু পানি যখন সমুদ্রের লবণাক্ত ভারী পানির সাথে মিশে, তখন সেটি সমুদ্রের পানির কলামে হরাইজন্টালি বা আনুভূমিকভাবে স্তর পুনঃবিন্যাস (স্ট্রেটিফিকেশন) না করে ভার্টিক্যালি বা উল্লম্বভাবে বিন্যস্ত হলেই সাগরের পানিতে অঙিজেন শূন্যতা তৈরি হয়।
সমুদ্রবিজ্ঞানীরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিক থেকে কঙবাজার সৈকতে এই লাল জোয়ার এর বিষয়টি লক্ষ্য করছেন। গত বছর জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহর শুরুতেও কঙবাজার শহরের লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্ট, দরিয়ানগর, হিমছড়ি ও পেঁচারদ্বীপ সৈকতে বঙ্গোপসাগরের বিষাক্ত ‘লাল জোয়ার’ আঁচড়ে পড়ে। এরআগে গত এপ্রিল মাসেও কঙবাজার সৈকতে লাল জোয়ার আচড়ে পড়ে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-