গিয়াস উদ্দিন ভুলু, কক্সবাজার জার্নাল :
রোহিঙ্গা ঠেকাতে সতর্কতা
মিয়ানমারের সংঘাতময় রাখাইন রাজ্যে সরকারি সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে আবারও ভয়াবহ লড়াই শুরু হয়েছে। জান্তার সেনারা বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালাচ্ছে। আর এতে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেষা এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা দিন কাটাচ্ছে ভয়ে আর আতংকে। তবে উদ্ভূত পরস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের আগমন ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
শনিবার (২৭ জানুয়ারী) বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ঘেষা এলাকায় মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের বেশ কয়েকটি এলাকায় থেমে থেমে গুলির বিকট শব্দ এবং ওপারে কয়েকবার কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে।
খবর নিয়ে জানা যায় ২৬ জানুয়ারি (শুক্রবার) বিকেল থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত গোলাগুলির শব্দে এপারের স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আবারও ভয়-ভীতি এবং আতংক বিরাজ করছে। এরমধ্যে শনিবার (২৭ জানুয়ারি) বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড উলুবনিয়া এলাকার নুরুল ইসলামের বসত বাড়িতে একটি এলএমজি’র গুলি এসে পড়ে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে গৃহকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, শনিবার সকাল থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া সীমান্তের মিয়ানমারের ওপারের মর্টারশেল ও ভারী গুলির ফায়ারের শব্দে এপারে ভেসে আসতেছে।
আমরা ভয়ে ও আতঙ্কে নিরাপদে সরে গেছি। হঠাৎ দেখি ভারী একটা গুলির শব্দ হলো। তখন দেখি আমার মেয়ের জামাইয়ের বসতঘরে টিনের দরজা ছিদ্র হয়ে বাড়িতে ডুকে পড়ে একটি গুলি। তখন আমরা আতঙ্কের মধ্যেই পড়ে গেছি। পরে বিজিবির সদস্যরা খবর পেলে তারা এসে বসত ঘরের ওঠান থেকে গুলি টা নিয়ে যায়।
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মো. সোলেমান বলেন, মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলির শব্দে বাড়ি ঘরে থাকতে পারতেছিনা। শনিবার নুরুল ইসলামের বসতঘরে এসে পড়লো একটি গুলি।এর গত এক সপ্তাহে ধরে এ সীমান্তের ওপারে মর্টারশেল ও গুলি’র শব্দে অনিরাপদ মনে করছি। আমরা ছেলে-সন্তান নিয়ে রাতে ও দিনের বেলায় সব সময় ভয়ের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বুচিডংয়ে ফুমালি নামে একটি রোহিঙ্গা গ্রামে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের জান্তা সরকারের মধ্যে গতকাল দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বহু রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে হতাহতের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র নিশ্চিত করতে পারেনি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ঘাঁটি থেকে আর্টিলারি গানসহ ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। আহত রোহিঙ্গাদের বুচিডংয়ের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটছে। অনেকে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। ২০১৭ সালে নিপীড়নের সময় রাখাইনের বুথিডং থেকে অনেক রোহিঙ্গা আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে এসেছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাখাইনসহ মিয়ানমারের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসব জায়গা পুনর্দখল করতে জান্তা সরকার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় যাতে ফের রোহিঙ্গার ঢল বাংলাদেশের দিকে না আসে, সেটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সন্ধ্যা এবং ভোর রাতের দিকে সীমান্তের ওপারের গুলির বিকট শব্দ আরও বেড়ে যায়। যা নিয়ে বসবাসরত মানুষ গুলোর মধ্যেও বিরাজ করছে আতংক।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিজিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার ভেতরে মিয়ানমারে সংঘর্ষ চলছে। একজন রোহিঙ্গারও যাতে অনুপ্রবেশ না ঘটে, এ ব্যাপারে সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা রয়েছে।
স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাখাইনে জান্তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। বিদ্রোহী গ্রুপটির কাছ থেকে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন শহরে চলছে তুমুল লড়াই। রাখাইনের বহু ঘরবাড়ি জান্তা বাহিনীর বোমার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে।
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল গফুর বলেন, ‘গত বুধ ও বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একাধারে কয়েক ঘণ্টা গুলির শব্দে সীমান্ত এলাকা ঘুমধুম ও পালংখালী এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।’
বান্দারবানের তুমব্রু ও টেকনাফ সীমান্তে মিয়ানমার অংশে থেমে থেমে ভারী গোলাগুলির বিকট শব্দ পাওয়া গেছে। শুক্রবার বিকেল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও টেকনাফ সীমান্তবর্তী শাহপরীর দ্বীপে ভারী গুলির শব্দে স্থানীয়দের মধ্যে আবারও ভয়ভীতি দেখা দিয়েছে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘ দিন পর তুমব্রু সীমান্তে আবারও মিয়ানমারের ভারী গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এতে সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা ভয়ভীতির মধ্য রয়েছে।’
জানতে চাইলে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, ‘সীমান্তে মিয়ানমারে মর্টারশেলের মতো বিকট গোলাগুলির আওয়াজ সীমান্তে বসবাসকারীদের মাধ্যমে অবহিত হয়েছি। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রেখেছি। তবে সীমান্ত দিয়ে কোনো লোকজন অনুপ্রবেশ করেছে কিনা, তা জানা নেই।’
সত্যতা নিশ্চিত করে টেকনাফ হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমেদ আনোয়ারী গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা তার এলাকার ওপারে শনিবার সকালে মর্টারশেলের মতো বিকট শব্দ শুনা গেছে। বিষয়টি সীমান্ত এলাকায় দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। নতুন করে কোন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন উক্ত বিষয়টি তার জানা নেই।
এদিকে ৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিজিবি সব সময় সতর্ক আছে। তিনি বলেন, সীমান্তে বসবাসরত গ্রামবাসীকে নিরাপদে রাখতে বিজিবি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তারা রাত-দিন কাজ করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
অন্যদিকে এ বিষয়ে টেকনাফ ২বিজিবি অধিনায়ক লে: কর্ণেল মো.মহিউদ্দীন আহমেদ জানান, টেকনাফ-মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে নতুন করে ফের ব্যাপক গোলাগুলি চলছে।
তিনি আরও বলেন,গত গত ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে ওপারে যুদ্ধ চলছে। এরপর থেকে সীমান্তে নিয়মিত টহল পাটিকে আরো জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের বিজিবি সৈনিকরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে,যাতে নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে না পারে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-