আবু সালেহ রনি :
সারা বছর নীরব থাকলেও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সামনে রেখে আবারও সক্রিয় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তড়িঘড়ি করে মাত্র ৪ দিনের নোটিশে গত ১১ ডিসেম্বর সভা করেছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বীকৃতি প্রদান-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, চলতি মাসের মধ্যে তৃতীয় দফায় শতাধিক শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এর আগে ২০২০ সাল থেকে দুই দফায় ৩৩৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে স্বাধীনতার পর প্রথম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ওইদিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সভায় প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২২২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা অনুমোদন করা হয়। পরে সেখান থেকে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন হওয়া ১৯১ জনের তালিকা প্রথম দফায় গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। গত বছর ২২ মে দ্বিতীয় দফায় ১৪৩ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামের গেজেট প্রকাশ করা হয়।
মন্ত্রণালয় বলছে, চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর গেজেটভুক্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারকে সহায়তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জানা গেছে, মন্ত্রণালয় এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বীকৃতি প্রদান-সংক্রান্ত সাব-কমিটির কাছে এই মুহূর্তে ২৭২ জনের তালিকা রয়েছে। এই তালিকা থেকেই চলতি মাসের মধ্যে তৃতীয় দফায় স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে গেজেট আকারে প্রকাশ করবে মন্ত্রণালয়।
গত বছরের ২৫ মার্চ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, সে বছরের ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজ শেষ হবে। মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রণয়ন সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি হলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী। তিনি যোগদানের পর গত ১১ ডিসেম্বর জাতীয় কমিটির সভা আহ্বান করা হয়। জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের বিষয়টি মন্ত্রীর নজরে এলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সচিবকে সভা আহ্বানের নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় ১১ ডিসেম্বর তড়িঘড়ি করে সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভা সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় কমিটি প্রাথমিকভাবে ২৭২ জনের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছে। ওইদিনই এ তালিকা যাচাইয়ের জন্য কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের সাব-কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে সাব-কমিটি। সূত্র জানিয়েছে, সাব-কমিটি ২৭২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তথ্য যাচাই করে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে জাতীয় কমিটির কাছে সুপারিশ পাঠাবে। এর আলোকে জাতীয় কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে দুই দফায় যে ৩৩৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাদের পরিবারকে এখনও রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা হয়নি। গেজেট প্রকাশের পর মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের পর তাদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কমিটিই এ বিষয়ে সুপারিশ করবে।
জানতে চাইলে মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কিছু নামের তালিকা মন্ত্রণালয় ও কমিটির কাছে জমা আছে। এগুলো নিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটি সিদ্ধান্ত দেবে। কমিটির সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।’ কমিটির বৈঠক না হওয়া প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি নজরে আসার পরপরই সভা আহ্বান করা হয়েছে। চলতি মাসেই তৃতীয় দফায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বীকৃতি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি এই সময়ের মধ্যে কমিটির সুপারিশ পাওয়া যাবে।’ স্বীকৃতি পাওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্মানী বা সহায়তার বিষয়ে এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, এটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন হলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে সরকার। মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সভাপতি করে কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তাসহ গবেষক সদস্য হিসেবে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের, ডা. বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ এবং গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের গবেষক গাজী সালাউদ্দিনকে রাখা হয়। মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মধ্যে কমিটিতে রয়েছেন– সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও গবেষক লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক। এই কমিটিই ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর এবং ২০২১ সালের ২৩ মার্চ দুই দফা বৈঠক করে ৩৩৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য সুপারিশ করে।
চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের বিলম্বের বিষয়ে জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘দিন বা মাস ধরে কাজ করার ধারণাটি আমলাতান্ত্রিক। সেটাই হয়েছে। নতুন যিনি আসেন বা আসবেন, তাঁকে আবার নতুন করে জাতীয় কমিটিকে বোঝাতে হয়, তাঁকেও (যিনি আসেন) বুঝতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলোকে এভাবে বিবেচনা করলে হবে না। কিন্তু এভাবেই হয়ে আসছে। তাই নিয়মিত সভা হয়নি। চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নে মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত গতি পাচ্ছে না।’
শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কত?
মুক্তিযুদ্ধে কতজন বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছেন– এমন পূর্ণাঙ্গ তথ্য কোথাও নেই। তবে ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী ১ হাজার ৭০ জন। ১৯৭১-এর ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাও ফরমান আলী এ দেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে হত্যা করা।’
এ ছাড়া ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার নির্মিত ‘বাংলাদেশ’ নামক প্রামাণ্য চিত্রে বলা হয়, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ শিক্ষক শহীদ হয়েছেন।’ তবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে হাজারও শহীদ বুদ্ধিজীবীর তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী, ৯ সাহিত্যিক ও শিল্পী, পাঁচজন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য পেশার দু’জন।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহের জন্য তখন বাংলা একাডেমি সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। এর পর বাংলা একাডেমি সিদ্ধান্ত নেয়, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, প্রকাশকসহ বিশেষ বিশেষ পেশাজীবী ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া ৩২৫ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করে পরে তাদের নিয়ে ‘স্মৃতি ৭১’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সবশেষ দশম খণ্ডে ‘স্মৃতি ৭১’ প্রকাশিত হয়। এর পর আর ‘স্মৃতি ৭১’ প্রকাশ করা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, ‘একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের যে আদর্শিক কারণে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ধারাবাহিকতা এখনও রয়েছে। এ জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনন্য অবদান ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হবে। এটি করতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্পূর্ণ হবে না।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-