উখিয়ার হলদিয়াপালং চৌধুরী পাড়ায় ৩৩৩০ কেজি ভিজিডি’র চাল জব্দ!

সাঈদ মুহাম্মদ আনোয়ার :

কক্সবাজারের উখিয়ায় দুস্থ মহিলা সহায়তা (ভিডাব্লিউবি) প্রকল্পের ৩৩৩০ কেজির ১১১ বস্তা চাল জব্দ করেছে র‌্যাব-১৫।

সোমবার (১৬ অক্টোবর) দিবাগত রাত পৌনে ১টার দিকে উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের রুমখাঁ চৌধুরীপাড়া এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।

র‍্যাব-১৫ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ল এন্ড মিডিয়া) মো. আবু সালাম চৌধুরী এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোমবার মধ্যরাতে উখিয়ার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের রুমঁখা চৌধুরী পাড়ায় অবৈধ ভাবে সরকারি চাউল বিক্রির খবরে র‌্যাবের একটি চৌকস অভিযানিক দল উখিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সালেহ আহমদের সহযোগিতায় মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করে খাদ্য অধিদপ্তরের ১শ ১১ বস্তা আতপ চাউল উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে উদ্ধারকৃত চাল গুলো জব্দ তালিকা তৈরিপূর্বক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে উখিয়া খাদ্য গুদামে জমা করা হয়েছে।

উখিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সালেহ আহমেদ জানান, চাউল উদ্ধারের অভিযানটি সম্পূর্ণ পরিচালনা করেছেন র‌্যাব-১৫।

অভিযান শেষে উপজেলা প্রশাসনকে খবর দিলে, ইউএনও এর নির্দেশে ঘটনাস্থলে গিয়ে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী চাউলগুলোর জব্দ তালিকা করে সরকারী খাদ্য গুদামে জমা দেওয়া হয়। এখন কার বাড়ি থেকে বা কার গুদাম থেকে চাউল গুলো উদ্ধার করা হয়েছে, কারা সরকারি চাউল গুলো পাচার, ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত সেটা র‌্যাব কর্তৃপক্ষ অবগত এবং তারাই সেটা ভালো বলতে পারবে। তাই লিখিত অভিযোগ প্রদান বা মামলা র‌্যাব-১৫ কেই করতে হবে।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, আমি এখনো অফিসিয়াল ভাবে লিখিত কোন অভিযোগ পায়নি, লিখিত অভিযোগ পেলে নিয়ম অনুযায়ী তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

র‌্যাব-১৫ এর কমান্ডিং অফিসার ( অধিনায়ক) লেঃ কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন জানান, হলদিয়ার চৌধুরী পাড়া থেকে সরকারী চাউল উদ্ধার বিষয়ে মামলার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরান হোসাইন সজীব জানান, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৪০ হাজার দুস্থ পরিবারের জন্য এ চাল বরাদ্দ দেয়। প্রতিটি ইউনিয়নে মাসে পরিবার প্রতি ৩০ কেজি করে এই চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জানান, উখিয়া উপজেলায় কি এখন চাউল কুঁড়ে পাওয়া যায়? র‍্যাবের আভিযানিক দল সরকারি চাউলগুলো কারো বাড়ি থেকে বা কোন গুদাম থেকে বা কোন গাড়ি থেকে তো উদ্ধার করেছে। এই চাল সরকারি খাদ্য গুদাম বা ইউনিয়ন পরিষদের গুদামে থাকার কথা, কিন্তু চাউল গুলো ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরীর মহল্লায় বা গ্রামে আসলো কিভাবে?

তিনি আরও বলেন, যার বাড়ি, গুদাম বা গাড়ি থেকে চাল গুলো উদ্ধার করা হয়েছে ও যারা সরকারী চাল ক্রয়-বিক্রয় এবং সরকারী চাউল গুলো পাচারে সহযোগিতা করে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন তাদের সকলেই বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য র‌্যাব-১৫ এর প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। এতে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও র‌্যাব এর ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে।

উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রত্না পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা জানান, র‌্যার-১৫ এর এ অভিযানটি সত্যি প্রশংসিত ছিলো। ভবিষ্যতে উখিয়ার মাদকসহ সকল প্রকার অপরাধ দমনে র‌্যাব আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুক সেটা সকলের কাম্য।

হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান আমিনুল হক আমিন জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সরকারি চাউল পাচারের ঘটনা সত্যি দুঃখজনক। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা জরুরি।

হলদিয়া পালং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. শাহ আলম অভিযোগ করেন, হলদিয়া পালং ইউনিয়নের পাঁচ হাজার দুস্থ নারীর জন্য বরাদ্দ করা চাল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হরিলুট চলে আসছে। এর সাথে সরাসরি জড়িত স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। এ বিষয়ে অবগত হয়ে ও অভিযোগ আমলে নিয়ে এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংশ্লিষ্টদের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

হলদিয়া পালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সাজু জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের ভোটের ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে, অন্যদিকে অসহায় দুস্ত ও গরীব মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে প্রদত্ত সরকারী চাউল যারা আত্মসাৎ ও পাচার করার অপচেষ্টায় জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক, “সুজনের” উখিয়ার সভাপতি সাংবাদিক নূর মোহাম্মদ সিকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, গরিবের হক আত্মসাৎ করে লুটপাটকারী দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সমীচীন হবে, নচেৎ এক্ষেত্রে দুর্নীতি আরো বেড়ে যাবে। শুভঙ্করের ফাঁকির মাধ্যমে গরিবের রিজিক চুরির হিড়িক পড়বে এবং সরকারের অভূতপূর্ব অর্জন বিসর্জনের সম্মুখীন হবে।

তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মহতী উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করতে উখিয়ার একশ্রেণীর লোভী দুর্নীতিপরায়ণ জনপ্রতিনিধিরা নয়,ছয়ের মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান করে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

মোজাহের কোম্পানির পরিবার সূত্রে জানা গেছে, জনৈক আরিফের কাছ থেকে সিরাজ চাল গুলো ক্রয় করেছে। পরে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে তার বাড়ি থেকে চাল গুলো জব্দ করে নিয়ে যায়।

হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী জানান, আমরা সরকারি নিয়ম ও নির্দেশনা অনুযায়ী চাউল গুলো বিতরণ করেছি তালিকাভূক্ত উপকারভোগীদের মাঝে। এখন কারা চাউল গুলো ক্রয়-বিক্রি করেছে, কারা মজুত করেছে সেটা চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের জানার কথা নয়।

কিন্তু চাল বিক্রেতা আরিফের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানায়, হলদিয়াপালং ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত ভিজিডির কার্ডধারীদের মাঝে বরাদ্দকৃত বিগত কয়েক মাসের চাল বিতরণ না করে, উপকারভোগীদের নিকট থেকে জোর পূর্বক টিপসই আদায়পূর্বক আদায় করা হচ্ছে হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদে। ঐসব চাউল পরে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরীর বিশ্বস্ত সহচর জনৈক আরিফের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দেন।
তারই ধারাবাহিকতায় আরিফের কাছ থেকে রুমঁখা চৌধুরী পাড়া গ্রামের মোজাহের কোম্পানির পুত্র উখিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক মো. আলমগীর ও সিরাজ চাউলগুলো ক্রয় করে পাচারের উদ্দেশ্যে তার বাড়ীতে মজুত করেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন।

এদিকে মোজাহের কোম্পানির বাড়ি ও গুদাম থেকে চালগুলো র‌্যাব ১৫ জব্দ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হলেও বিষয়টি বর্তমানে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চাল গুলো পরিত্যাক্ত উদ্ধার দেখানোর পায়তারা করছে। পাশাপাশি প্রশাসনের পারস্পারিক বিরোধী বক্তব্য নিয়ে সর্বমহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

সচেতন মহলের মতে, প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে চাল গুলোর প্রকৃত মালিক কে? চাল বহনকারী পরিবহনটি কার? কোথায় থেকে, কারা চাল গুলো এনে মজুত করছে? তার বিস্তারিত আদ্যোপান্তর তথ্যের তলের বেড়াল বেরিয়ে পড়বে।

এদিকে ঘটনার সাথে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা না হওয়ায় উখিয়া সচেতন মহল সহ সর্বত্র মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সকলের প্রশ্ন যেভাবে গর্জন হলো, সেভাবে বর্ষণ হলো না।

উল্লেখ্য, হতদরিদ্র পরিবারগুলোর খাদ্যের যোগান দিতে প্রধানমন্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিশেষ কর্মসূচি তথা শেখ হাসিনার নির্দেশ ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ এই স্লোগানের আলোকে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।

আরও খবর