আবদুল কুদ্দুস, কক্সবাজার •
কক্সবাজার শহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে রামু উপজেলার রাজারকুল বনাঞ্চল। জলবায়ু তহবিলের প্রায় ৪ কোটি টাকায় বনাঞ্চলের ৬৫ একর জায়গায় ২০১৩ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন (উদ্ভিদ উদ্যান)।
শুরুর কয়েক বছর দর্শনার্থীদের পদচারণে উদ্যানটি মুখর থাকলেও কয়েক বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থেকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছে এটি। পুরো উদ্যান ঝোপজঙ্গলে ভরে উঠেছে। ফুলের বাগান, শৌচাগার, বসার ঘর, পানি সরবরাহের লাইন, স্বচ্ছ জলের হ্রদ, কাঠের সেতুসহ নানা অবকাঠামো অযত্ন–অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। উদ্যানের ভেতরে থাকা বৈলাম, বাটনা, গর্জন, সোনালুসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছও উজাড় হচ্ছে।
২০১৩ সালের ৫ জুলাই পরিবেশবান্ধব এই উদ্যানের উদ্বোধন করেন তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এর পর থেকে স্থানীয় লোকজন ও শিক্ষার্থী, গবেষকদের জন্য উদ্যানটি উন্মুক্ত করা হয়।
জলবায়ু তহবিলের টাকায় করা উদ্যানের এমন হাল কেন, জানতে চাইলে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সরওয়ার আলম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনটি সরকারি গেজেটভুক্ত না হওয়ায় কোনো জনবল নিয়োগ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা যাচ্ছে না। যে কারণে উদ্যানটির এমন চেহারা।
এখন ২৫০ একর বনভূমি নিয়ে মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডের আদলে রামুর এই বোটানিক্যাল গার্ডেনটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে বলে জানান সরওয়ার আলম। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় আগের ৬৫ একরের বোটানিক্যাল গার্ডেনের সংস্কার, উন্নয়নকাজসহ বিরল ১০০ প্রজাতির বিভিন্ন ফুল ও ফলের চারা রোপণ করা হবে।
ঝোপ-জঙ্গলে ছেয়ে গেছে উদ্যান
৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে উদ্যানে গিয়ে দেখা গেছে, ফটকের গেট বন্ধ। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কয়েকজন দর্শনার্থী। তাঁরা ভেতরে পায়চারি করা একটি বন্য হাতি দেখছিলেন। কেউ মুঠোফোনে হাতির ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করছিলেন। ফটকে বন বিভাগের কাউকে দেখা গেল না।
গেটের সামনে খোলা জায়গায় স্তূপ করে রাখা ছিল চেরাই করা কাঠ। উদ্যানের ভেতরে ফুলের বাগানের কোনো চিহ্ন নেই। দর্শনার্থীদের বসার ঘর, কাঠের সাঁকো, হ্রদ, পানি সরবরাহের লাইন, কটেজ-বাংলো সবই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। উদ্যানের পশ্চিম পাশে (সড়কের কাছে) পাকা দেয়াল। তিন দিকের অংশের কাঁটাতারের যে বেড়া দেওয়া ছিল, তা–ও বহু জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। নেই খুঁটিও। চোরের দল উদ্যানের ভেতরে ঢুকে গাছপালা কেটে নিয়েছে।
গত সোমবার দুপুরে দ্বিতীয়বার উদ্যানে গিয়ে একই দৃশ্য দেখা গেছে। পরিত্যক্ত উদ্যান দেখে হতাশা ব্যক্ত করেন কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ও আইনজীবী আয়াছুর রহমান। ঘটনাস্থলে তিনি বলেন, জলবায়ু তহবিলের কয়েক কোটি টাকা খরচ করে এই বোটানিক্যাল গার্ডেনটি গড়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় অযত্ন–অবহেলায় উদ্যানটি ধ্বংস করা হয়েছে। জলবায়ু তহবিলের বিপুল অঙ্কের টাকা জনগণের কোনো কাজে আসেনি।
কয়েকজন বন্ধু নিয়ে উদ্যান দেখতে আসেন কলেজছাত্র জাহিদুল ইসলাম। তাঁর বাড়ি রামুর উত্তর মিঠাছড়ির চা–বাগান এলাকায়। জাহিদুল (২১) বলেন, চার বছর আগেও তাঁরা কয়েকজন উদ্যানে গিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বাগান দেখতে পেয়েছিলেন, এখন তার চিহ্নও নেই। পুরো উদ্যানটি ঝোপজঙ্গলে ভরা। তাতে বন্য প্রাণীর বিচরণ থাকায়, কেউ ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছেন না। প্রধান ফটকের গেট সব সময় বন্ধ থাকে।
ফটকের এক পাশে বড় একটি সাইনবোর্ড টাঙানো, তাতে তাতে লেখা আছে ‘কক্সবাজার বোটানিক্যাল গার্ডেন, রাজারকুল। শুভ উদ্বোধন করেন ড. হাছান মাহমুদ এমপি, মাননীয় মন্ত্রী পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।’
তিন বছর ধরে এই রেঞ্জের দায়িত্বে থাকা বন রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, উদ্যানটি দেখভালের জন্য কমপক্ষে চারজন ফরেস্ট গার্ড ও চারজন বাগান মালি দরকার। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে উদ্যানে একজন মালিও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এই পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণের বিপরীতে এক টাকাও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেনটি সরকারি গেজেটভুক্ত করা হয়নি। বন বিভাগের নথিতেও বোটানিক্যাল গার্ডেনের অস্তিত্ব নেই।
বনকর্মীরা জানান, তিন দিকের কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় প্রতিনিয়ত সাত-আটটি বন্য হাতি উদ্যানের ভেতরে এসে গাছপালা খেয়ে ফেলছে। আশপাশের বনাঞ্চলে হাতি আছে ১৫টির বেশি। এ কারণে উদ্যানের ভেতরে দর্শনার্থীদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সে জন্য প্রধান ফটক তালাবদ্ধ রাখা হয়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-