ফের বেপরোয়া ইয়াবা ডন নুরুল হুদা মেম্বার!

বিশেষ প্রতিবেদক •

আত্মস্বীকৃত ১০২ জন ইয়াবা কারবারির অন্যতম নুরুল হুদা, যিনি ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও অস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ৩ ডজনের বেশি মামলা। গেলো ২০২০ সালের ২ মার্চ সম্পদ বিবরণী দাখিল না করা এবং ২,৭১,২৫,৩৩৭ টাকার জ্ঞাত বহির্ভুত সম্পদ অর্জনপূর্বক ভোগ দখলের অপরাধে নুরুল হুদার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

মহানগর দায়রা জজ ও চট্টগ্রাম মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আজ আদালতে মামলাটি করেন দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর। যার মামলা নং-৪/২০২০।

সর্বশেষ গত ২৯ আগস্ট তার এম্বুলেন্স করে পাচারকালে একটি ইয়াবার চালান কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের মুহুরীপাড়াস্থ আলী আহমদ অটো রাইচ মিলের সামনে জেলা গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আটক হয়। এতে প্রায় এককোটি ঊনষাট লাখ টাকা মূল্যের ৫৩ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে কক্সবাজার সদর থানায় তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার মামলা নং ৭৩/৪৮৭।

জানা যায়, নুরুল হুদা এক সময় গাড়ির হেলপার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন নুরা বলে। অপর পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ছোট দুজনকে নিয়ে নাফ নদীতে জাল ফেলতেন তাদের বাবা। তিনজন পরের জমিতে লবণ শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু যাদের জমিতে চাষ দিতেন, কয়েক বছরের মাথায় ইয়াবা ব্যবসার বদৌলতে সেই জমিই কিনে নেন নুরুল হুদা। মহাসড়কের ধারে গড়ে তোলেন দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। তার পর একেক ভাইয়ের জন্য বানান একেকটি প্রাসাদ। ওঠাবসা ছিল অনেক প্রভাবশালীদের সাথে। পরে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পদে নির্বাচন করেন। বনে যান নেতা। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদ ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার হন নুরুল হুদা।

সূত্র মতে, নুরুল হুদা টেকনাফের হ্নীলা ৮নং ওয়ার্ডের ৩ বারের নির্বাচিত মেম্বার। গেলো নির্বাচনের ভোটের মাঠে জয়ী হতে প্রচুর কালো টাকা বিনিয়োগ করে নির্বাচনেও বিজয়ী হন।

বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এককালের সেই হেলপার নুরা আজ শতকোটি টাকার মালিক। হ্নীলার টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের পাশেই তাদের ছয় ভাইয়ের নামে ৬টি নান্দনিক বাড়ি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে তাদের বাড়ির সংখ্যা ১৪। টেকনাফের হোছ্যারখালের উত্তর পাশে, হ্নীলা আলীখালী, লেদাবাজার এলাকায় হুদার নিজেরই তিনটি বাড়ি। নিজে বসবাস করেন পুরান লেদায়। ফ্ল্যাট আছে চট্টগ্রামে। তবে হ্নীলার দমদমিয়া বিজিবি চেকপোস্ট ঘেঁষে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করেন ছোট ভাই নূর মোহাম্মদ। যিনি ২০১৪ সালে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন নূর মোহাম্মদ।

এছাড়া হ্নীলা লেদায় শত একর জমি কিনে নিয়েছে এই ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। পুলিশের খাতায় মোস্ট ওয়ান্টেড নুরুল হুদা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হ্নীলার জাদিমুড়া থেকে খারাংখালী এলাকা পর্যন্ত নাফ নদীর দুই পাশে ইয়াবার সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন নুরুল হুদা। জাদিমোড়া, নয়াপাড়া, মোচনী, লেদা, রঙ্গীখালী, নাটমোড়া পাড়া, হ্নীলা সদর, ওয়াব্রাং ও খারাংখালী পয়েন্ট হয়ে প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে তার নামে ইয়াবার চালান আসত। সন্ধ্যার পর এসব খোলা বিলে লোকজনের উপস্থিতি না থাকায় ইয়াবা চোরাচালানের একটি অন্যতম রুটে পরিণত হয়। বর্তমানে নুরুল হুদার একাই প্রায় শতকোটি টাকার মালিক বনে আছেন। তিনি একাধিকবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন।

পুলিশ জানায়, নুরুল হুদা হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সরওয়ার কামাল হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। তিনি ও তার সব ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন-পুরনো সবকটি তালিকাভুক্ত ইয়াবা পাচারকারী। ২০১৪ সালে আত্মগোপনে থেকে মেম্বার নির্বাচিত হলেও শপথ নিতে পারেননি। পরে ২০১৬ সালে কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রাতের আঁধারে শপথ গ্রহণের চেষ্টা করেন। পুলিশ জানায়, এরা পারিবারিকভাবে ইয়াবা ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় ভাই শামসুল হুদা যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন। নুরুল কবির, সরওয়ারসহ অন্য ভাইরাও ফেরার।

অনুসন্ধানে জানা যায়, লেদা পশ্চিম পাড়ার মৃত আবুল কাশেমের ছেলে নুরুল হুদা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানাসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে ইয়াবা, অস্ত্র, হত্যা মামলাসহ নানা অপরাধে ৫০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। যা বিচারাধীন আছে। এমন একজন চি‎হ্নিত রাষ্ট্রদ্রোহী, চোরাকারবারী, সরকারের আত্মস্বীকৃত ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে যা ন্যাক্কারজনক ও নিন্দনীয়। জাতি এই ভয়াবহ মরণনেশা ইয়াবা কারবারীর নিকট জিম্মি।

এদিকে, একজন চিহ্নিত মাদক কারবারী কিভাবে বীরদর্পে চলাফেলা করে; নির্বাচনে জেতে, তা নিয়ে উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন কক্সবাজার আদালতের আইনজীবী ও দুদকের পিপি আবদুর রহিম।

তিনি বলেন, নুরুল হুদা আত্মস্বীকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ী। অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

দুদকের এই পিপি দুঃখ করে বলেন, অনেক আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারী কারামুক্ত হয়ে বেপরোয়া জীবন যাপন করছে। মাদক কারবারে জড়িয়েছে। জনগণ তাদের ভোট কেন দেয়, বুঝিনা। আত্মস্বীকৃত অপরাধীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিৎ।

আরও খবর