* বিনিময়ে চোরাই পথে আসছে গরু, মাদকদ্রব্য
* এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আড়ালে হুন্ডি রমরমা
জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার •
প্রায় এক বছর ধরে মিয়ানমার থেকে অবৈধপথে আসা গরুর ব্যবসা করছেন কক্সবাজারের রামু উপজেলার ছৈয়দ নুর (ছদ্মনাম)। প্রতি সপ্তাহে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে আনছেন পালে পালে গরু।
সেগুলো দেশের বিভিন্ন জেলার গরু ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যায় তার মাধ্যমে। ফলে সব মিলিয়ে প্রতি মাসে তার গরুর ব্যবসা হয় কয়েক কোটি টাকার। এই টাকার সিংহভাগ পাঠান হুন্ডির মাধ্যমে।
কীভাবে এত কোটি টাকা মিয়ানমারে পাঠানো হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে নগদ টাকাই পাঠাতাম। গরু পাচারকারীদের সঙ্গে টাকা পাঠাতে অনেক ঝুঁকি নিতে হতো। অনেকে টাকা মেরেও দিয়েছে। পরে এক বন্ধু হুন্ডিতে পাঠানোর পরামর্শ দিল। পরের মাসে হুন্ডি করলাম। সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারে টাকা চলে গেল। গরুর দামও আগের চেয়ে কম রাখল। এরপর থেকে হুন্ডিতে টাকা পাঠাই।
ছৈয়দ নুরসহ অন্তত ২০ জন গরু ব্যবসায়ী বলেন, কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়িসংলগ্ন এলাকার মৌলভী বদরুল আলমের ছেলে তৌহিদুল ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধীন নাইক্ষ্যংছড়ি থানার সামনে ইসলামী ব্যাংকের একটি এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা রয়েছে।
ব্যাংটির ইনচার্জ তৌহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির হাতে টাকা দিলেই মিয়ানমার থেকে গরু চলে আসে বাংলাদেশে। তার হুন্ডি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শতাধিক গরু ব্যবসায়ী হাজার কোটি টাকা মিয়ানমারে পাঠান বলে জানান তিনি।
এক গরু ব্যবসায়ী বলেন, গরু আনতে মিয়ানমারে নগদ টাকা পাঠাতে অনেক ঝুঁকি আছে। এখন তৌহিদের হাতে টাকা দিলে তিনি (তৌহিদ) ফোন দিলে গরু চলে আসে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে থাকা তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পৌঁছে দেন গর্জনিয়া বাজার পর্যন্ত। কমিশন বেশি দিলে তৌহিদের মাধ্যমে বাকিতেও গরু আনা যায়। পরে সেই গরু বিক্রি করে তৌহিদের হাতে ওই টাকা বুঝিয়ে দিলেই হয়ে যায়।
নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলী কদম সীমান্তের একাধিক পয়েন্ট থেকে অবৈধ পথে গরু পাচার শুরু হওয়ার পর এভাবেই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করে গত এক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তৌহিদ। নামে-বেনামে কিনেছেন বহু জায়গা-জমি। হুন্ডি ব্যবসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গর্জনিয়া বাজারে গড়ে তুলেছেন দুটি বিকাশের দোকান। মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টসহ এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা তিনি ও তার দুই ভাই সহজেই পাচার করছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, চোরাচালানের রোড হিসাবে পরিচিত বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ফুলতলি, ভালুক্কায়া, বাইশারী, তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি, বম্বনিয়া এবং রামুর হাজিরপাড়া, মৌলভীরকাটার বেশ কিছু চোরাকারবারি, বাজার ইজারাদার ও স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিকে সঙ্গে নিয়ে এই অবৈধ বাণিজ্য করে আসছেন তিনি। এতে করে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব যেমন হারাচ্ছে, ঠিক তেমনি মাদক বিস্তারের সুযোগও তৈরি করেছে এই চক্রটি। তৌহিদ ছাড়াও এই চক্রে জড়িত আছে তার দুই ভাই, রাসেল, কাইছার ও কচ্ছপিয়ার নোমান চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মো. শওকতসহ নাইক্ষ্যংছড়ি গর্জনিয়ার অন্তত ২০ হুন্ডি ব্যবসায়ী।
চক্রটির শত শত কোটি টাকা পাচার হচ্ছে তৌহিদুল ইসলামের হাত ধরে। সম্প্রতি অবৈধ গরু চোরাচালানের দায়ে চক্রটির বিরুদ্ধে নাইক্ষ্যংছড়ি বিজিবি বাদী হয়ে একটি মামলাও করেছে। সেখানে হুন্ডির প্রধান হোতা তৌহিদকে চার নম্বর আসামি করা হয়েছে। তৌহিদের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ২শ গজের ভেতরে নাইক্ষ্যংছড়ি বিজিবি ক্যাম্প, থানা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থাকার পরও প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে প্রতিদিন তৌহিদ কোটি টাকা মিয়ানমারে কীভাবে পাচার করছেন সেই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।
উল্লিখিত সীমান্ত এলাকার বাইরে রামু গর্জনিয়া বাজারে অবৈধভাবে আসা মালামালের দামও পরিশোধ করা হয় তার দুটি বিকাশের দোকান থেকে হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে গর্জনিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে প্রতিদিন অন্তত কয়েক কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। বিনিময়ে ওপার থেকে অবৈধভাবে আনা হচ্ছে গরু, মাদকসহ বিভিন্ন মালামাল। এসব অবৈধ কারবার চলতে থাকায় রাজস্ব আয় ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
জানা যায়, তৌহিদ টাকাগুলো সংগ্রহ করে ব্যাংকে টিটি (টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার) করে হুন্ডি ব্যবসার ‘ডিলারদের’ কাছে পাঠান। এরপর সেখান থেকে নানা কৌশলে টাকা চলে যায় মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের হাতে। এভাবে হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর বিনিময়ে বড় অঙ্কের কমিশন নেন তৌহিদ।
চোরাচালানে জড়িত একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা দিয়ে মাসে অন্তত ৫০ কোটি টাকার ইয়াবা পাচার করে আনা হয় মিয়ানমার থেকে। এর বাইরে এ সীমান্ত এলাকা দিয়ে আসে গরু, মহিষসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ পণ্য। এসব আনতেও প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয় মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। অন্যদিকে গর্জনিয়ার সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকে মাসে অন্তত ৪০ কোটি টাকার সিগারেট, শুকনা সুপারিসহ নানা পণ্য।
স্থানীয়রা বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যরা শুধু ইয়াবা কারবারিদের নিশানা করলেও নিরাপদেই রয়ে গেছে এইসব হুন্ডি সিন্ডিকেট। সে কারণে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বেশ কয়েকজন ইয়াবা কারবারি নিহত হলেও অবৈধ চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না। কারণ ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে হুন্ডি সিন্ডিকেটের সদস্যদের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। ইয়াবা কারবারও চলে হুন্ডির মাধ্যমেই।
হুন্ডির মাধ্যমে কোটি টাকা মিয়ানমারে পাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট শাখার ইনচার্জ তৌহিদুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে বিজিবির দায়ের করা মামলার বিষয়টি ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন। একাধিক গরু ব্যবসায়ী তার মাধ্যমে টাকা পাচারের স্বীকারোক্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং প্রতিবেদককে নিউজ না করার জন্য নানাভাবে তৎপরতা চালান। এ বিষয়ে দেখা করে একটি সমাধান করতে চান বলে জানান।
জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড চট্টগ্রাম জোনের ইনচার্জ শফিউল ইসলাম বলেন, এজেন্ট ব্যাংকের আড়ালে হুন্ডি বা মানি লন্ডারিংয়ের কোনো সুযোগ নেই। শুধু এজেন্ট কেন মূল ব্রাঞ্চেও মানি লন্ডারিং করার কোনো সুযোগ নেই। এজেন্টের এ ধরনের কার্যক্রমের যদি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ টান্টু সাহা বলেন, তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে গরু চোরাচালানের একটা মামলা হয়েছিল। তবে সে বর্তমানে জামিনে রয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে কোটি টাকা মিয়ানমারে পাচারের বিষয়ে ঠিক জানা নেই। অভিযোগের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে তাকে নজরদারিতে রাখা হবে বলে জানান তিনি।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমেন শর্মা বলেন, এজেন্ট ব্যাংকের আড়ালে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের বিষয়টি জানা ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে সম্পৃক্ততা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-