শিক্ষকতা ছেড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা

আরসার অর্থ সম্পাদক ইউনুস অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার: বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য!

আবদুল্লাহ আল আজিজ, কক্সবাজার জার্নাল •

সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ওই সংগঠনের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুসকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-১৫। এসময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি রিভলবার, ৬ রাউন্ড তাজা কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।

বৃহস্পতিবার (২৪ আগষ্ট) রাত ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে উখিয়ার পালংখালীর তাজনিমারখোলা এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়।

শুক্রবার দুপুরে ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জামিলুল হক।

তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‍্যাবের কাছে খবর আসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন গহীন পার্বত্য এলাকাসমূহে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা)’সহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। যার কারণে রোহিঙ্গা শিবির ও স্থানীয় এলাকাবাসী সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। এর প্রেক্ষিতে র‌্যাব-১৫ এ সকল সন্ত্রাসী গ্রুপের শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।

তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল র‍্যাবের চৌকস আভিযানিক দল উখিয়ার পালংখালী তাজনিমার খোলা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও অর্থ সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুস’কে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুস চেংখালী ক্যাম্প-১৯ এর ব্লক-সি/১৩ এলাকার মৃত হাবিবুল্লাহর ছেলে।

সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জামিলুল হক আরও জানান, মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুস মায়ানমারে থাকাবস্থায় মংডু টাউনশীপের মেরুল্লা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতো এবং শিক্ষকতার আড়ালে আরসার হয়ে কাজ করতো।

সে ২০১৬ সালে ‘আরসা’ সদস্য মৌলভী আরিফুল্লাহর মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘আরসা’ তে যোগ দেয়। সে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী, ওস্তাদ খালেদ, সমিউদ্দিন এর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলেম-ওলামা, হেডমাঝি, সাবমাঝি ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের সাথে মিটিং করে আরসা সংগঠনে যোগদানের জন্য উৎসাহ প্রদান করতো। এছাড়াও সে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় আরসার অর্থ সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে এবং আর্থিক তহবিল পরিচালনা করছে বলে জানা যায়। পরবর্তীতে সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৯ এ অবস্থান করতে থাকে।

আরসার অর্থের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে মাওলানা ইউনুস জানায়, তার নিকট প্রতিমাসে সৌদি আরব থেকে আবুল বশর ১ লক্ষ টাকা, মৌলভী ইসমাইল ১ লক্ষ টাকা, পারভেজ ১৫ হাজার টাকা, আমেরিকা থেকে জহুর আলম ১ লক্ষ টাকা, মালয়েশিয়া থেকে হারুন ১ লক্ষ টাকা, থাইল্যান্ড হতে হারুন ৬৫ হাজার টাকা এবং সৌদি আরব থেকে মো. ইসলাম প্রতিবছর ১ লক্ষ টাকাসহ সর্বমোট ৫ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা প্রেরণ করে। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া থেকে অজ্ঞাত রোহিঙ্গারা টাকা প্রেরণ করে বলে জানা যায়।

এছাড়াও মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রাম হতে চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। প্রতিমাসে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০-১৫ লক্ষ টাকা আরসার ক্যাম্প জিম্মাদারদের নিকট থেকে আসে। প্রাপ্ত অর্থসমূহ দিয়ে অস্ত্র কেনা ও দলের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা/বেতন দিয়ে থাকে। বর্তমানে মাওলা ইউনুসের নিকট তার বিকাশ একাউন্ট আনুমানিক ৩৩ থেকে ৩৭ হাজার টাকা হয়েছে বলে জানা যায়।

তিনি আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, মাওলানা ইউনুস আরসার সংগঠনের জন্য গত এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত ৩ মাসে আরসা সমর্থিত বিভিন্ন গ্রুপ, ব্যক্তি ও সংগঠন হতে প্রায় ১৩,৮১,৬৯৫ ( তেরলক্ষ একাশি হাজার ছয়শত পঁচানব্বই) পেয়েছেন।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত মাওলানা ইউনুস জানায়, আরসার গ্রুপে ২০০-২৫০ জন সদস্য রয়েছে। আরসা সদস্যরা ২০১৬ সালে মায়ানমারে তারাশুখ থানায় আক্রমন করে মোট ৭০টি একে-৪৭ অস্ত্র লুট করে এবং এটি তাদের অস্ত্র সরবরাহের মূল উৎস বলে জানা যায়।

সে আরো জানায়, আরসার অন্য সদস্য সমিউদ্দিন (ক্যাম্প-৬) এবং হোসেন (ক্যাম্প-১৭) অস্ত্র ও এ্যামোনিশনের ব্যাপারে বিস্তারিত জানে। এছাড়াও ছোট ছোট অস্ত্র ও এ্যামোনিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা হতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরবরাহ করে থাকে। আরসা সদস্যরা অস্ত্রগুলো ক্যাম্পে নিয়ে আসার পর সমিউদ্দিন ও ইউনুসের নিকট জমা থাকে এবং পরবর্তীতে তাদের অধীনস্থ সকল সদস্যদের অস্ত্র বন্টন করে থাকে।

মাওলানা ইউনুস জানায়, আরসা সন্ত্রাসী সমিউদ্দিন ও জোবায়ের ককটেল বোমা বা বিস্ফোরক তৈরী করে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেশীয় তৈরী এলজি অস্ত্রের চাহিদা বেশি। আরসা সদস্যরা অস্ত্র ক্রয় করার পর নগদ অর্থ হাতে হাতে লেনদেন করে অথবা বিকাশের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করে।

মায়ানমারের বুচিডং ও মন্ডু শহরের মাঝে বিভিন্ন ছোট ছোট পাহাড়ে ওস্তাদ খালেদ, সামসু এবং হামিদ হোসেন আরসা সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়। আরসা সদস্যদের জন্য নির্দিষ্ট কোন রাউন্ড এ্যামোনিশন বরাদ্দ নেই তবে বিভিন্ন অপারেশনের পূর্বে বেশি করে এ্যামোনিশন প্রদান করা হয়। এছাড়া মাওলানা ইউনুসের নিকট হতে আরসা সদস্যদের বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ পাওয়া যায়। যা হলো: KRG/KIG – পাহারাদার গ্রুপ – ১৩-১৫ বছর বয়সের আরসা সদস্য, G-4 – মাস্টার রফিক, L/L. Gan – যোবায়ের (আঙ্গুল বাকা) এবং 5.S/5.Star – মাস্টার ইউনুস। বর্তমানে আরসার নিকট প্রায় ২০টি টাইপ-৭৪ এলজি, জেআরজি অস্ত্রসহ ও বিপুল পরিমানে হাত বোমা (হ্যান্ড গ্রেনেড) রয়েছে বলে জানা যায়। আরসা কমান্ডার সমিউদ্দিনের সাথী রোহিঙ্গা ফরিদ, মোহাম্মদ উল্লাহ এবং ইউসুফসহ অনেকের নিকট অস্ত্র রয়েছে বলে জানা যায়।

র‍্যাব কর্মকর্তা আরও জানান, গ্রেফতারকৃত মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুনের পিসিপিআর যাচাই করে তার বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় ৫টি মামলা পাওয়া যায়। এই ৫টি মামলাগুলো হলো গেলো বছরের ১৫ অক্টোবর হেডমাঝি আনোয়ার কুপিয়ে হত্যা, চলতি বছরের ৩রা মার্চ রোহিঙ্গা মোহাম্মদ রফিক গুলি করে হত্যা, ১৩ মার্চ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগনোর নির্দেশদাতা, ১১ এপ্রিল ৯ জুন এপিবিএন কর্তৃক আরসা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকালে তাদের উপর সশস্ত্র হামলা।

এছাড়াও তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও কয়েকটি হত্যাকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিল মর্মে স্বীকারোক্তি প্রদান করে।

তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর আরসার সস্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৮ এর একটি আবাসিক মাদ্রাসায় অবস্থানরত ৬জন শিক্ষক ও ছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা ও চলতি বছরের ৩ মার্চ ইসলামী মাহাযের নেতা রফিক এবং ১৮ মার্চ ইসলামী মাহাযের নেতা হাফেজ মাহবুবকে হত্যা সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে।

গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন র‍্যাবের এ কর্মকর্তা।

আরও খবর