আবদুল্লাহ আল আজিজ, কক্সবাজার জার্নাল •
ছয় বছর আগে ঘটে যাওয়া গণহত্যার বিচার ও নিজেদের ভিটেবাড়িতে পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে ফেরার আকুতি জানিয়ে সাত দফা দাবিতে সমাবেশ করেছেন রোহিঙ্গারা।
গণহত্যা দিবস পালন উপলক্ষে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে পৃথক পৃথক জায়গায় এ সমাবেশ করেছেন তারা।
সমাবেশে বক্তব্য দেন রোহিঙ্গা নেতা ডা. জুবাইর, সৈয়দুল আমিন, মাষ্টার মুসা, সৈয়দ উল্লাহ, মিয়ানমারে সামরিক জান্তার নিয়ার্তনের শিকার মাষ্টার রফিক, মাষ্টার কামাল উদ্দিন, মাষ্টার শোয়াইব ও রোহিঙ্গা নারী শাহিদা, জুমাদিলা বেগমসহ অনেকে।
হাজার হাজার রোহিঙ্গারা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করেন।
সমাবেশে ২০১৭ সালের এ দিনে মিয়ানমার সামরিক জান্তা ও তাদের দোসর রাখাইন কর্তৃক নির্মম গণহত্যার বিচার ও বাপ-দাদার ভিটায় ফেরার দাবি জানান তারা।
সমাবেশে ইংরেজিতে লেখা একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন- আজ, যখন আমরা রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবসের ৬ষ্ঠ বার্ষিকী স্মরণে জড়ো হয়েছি, তখন আমাদের সেই ট্র্যাজেডির ক্ষণগুলো খুব বেশি তাড়িত করে চলেছে। এ দিনটি রোহিঙ্গাদের দ্বারা সহ্য করা ক্ষতি, দুর্ভোগ এবং অকল্পনীয় নৃশংসতার বেদনা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সমাবেশে তারা ৭টি দাবী উল্লেখ করেন, তা হলো দ্রুত ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে আরাকানের গ্রামে গ্রামে প্রত্যাবাসন, রাখাইন রাজ্যে আইডিপি ক্যাম্প বন্ধ করে সেখানে তাদের মধ্যে পুনর্বাসন করা, প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত প্রত্যেক চুক্তি ও প্রক্রিয়ায় অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, বাংলাদেশ, এনজিও, সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা, বার্মার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল, সম্পত্তি ফেরত, নিরাপত্তা নিশ্চিত ও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারসহ মায়ানমারে নিরপরাধ মানুষের উপর নির্যাতন বন্ধ করা।
তারা বলেন, মায়ানমার আমাদের মাতৃভূমি হওয়া সত্বেও আমরা যুগ যুগ ধরে মায়ানমার সরকার দ্বারা অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছি। আমাদের সন্তানদের পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ঘরবাড়িতে, অগণিত রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছিল, আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, বাড়িঘর এবং আমাদের গ্রামে আগুন দেওয়া হয়েছিল। নিরপরাধের জীবন ও ভবিষ্যৎ কেড়ে নেয়া হয়েছে।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি বেঁচে থাকা, সাক্ষী এবং গণহত্যার শিকার হিসেবে। সেই মর্মান্তিক দিনের পর ছয় বছর পার হয়ে গেছে তবুও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ন্যায়বিচারের সন্ধান অধরা।
১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১২, ২০১৬,২০১৭ সালে মায়ানমার সরকার আমাদের উপর একই ধরনের অত্যাচার নিপীড়ন করে আমাদের নিজ দেশ হতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে বিতাড়িত করে।
শেষে ২০১৭ সালে তাদের গণহত্যার মুখে ১.১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা নিজ দেশ মায়ানমার হতে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করি। আমাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। পাশাপাশি খাদ্য, আশ্রয় এবং অন্যান্য সমর্থন প্রদানের জন্য জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
কিন্তু, বাংলাদেশ আমাদের দেশ নয়। আমরা আমাদের হোমল্যান্ড মায়ানমারে ফিরে যেতে চাই। ২০১৭-২০১৮ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহায়তায় বাংলাদেশ ও মায়ানমারের বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু, মায়ানমারে আমাদের ফেরত পাঠানোর জন্য কোনও দৃশ্যমান এবং কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছয় বছর পার হয়ে গেছে। আমরা কত দিন গৃহহীন থাকব? আমরা আর গৃহহীন থাকতে চাই না। আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা মায়ানমারে আমাদের মাতৃভূমি আরাকানে ফিরে যেতে চাই এবং সঠিক অধিকারের সাথে নাগরিক হিসাবে সেখানে থাকতে চাই।
আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি, ন্যায়বিচারের পথ এত কঠিন কেন? যত দিন যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের আস্থা কমছে।
সুতরাং, আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ও সম্প্রদায়গুলিকে এগিয়ে আসার জন্য এবং আমাদের দেশ মায়ানমারে যাতে করে পূর্ণ অধিকারসহ দ্রুত ফিরে যেতে পারি সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ করছি। আমরা আসন্ন গ্রীষ্মের মধ্যে নিরাপত্তা এবং মর্যাদার নিশ্চয়তাসহ আমাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করতে চাই।
রোহিঙ্গা নেতা ডা. জুবায়ের বলেন, সম্মানজনক প্রক্রিয়ায় আমরা নিরাপদ প্রত্যাবাসন চাই। আমাদের আশা সমাবেশে উত্থাপিত রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক দাবিগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব পাবে।উক্ত সমাবেশে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশ শেষে দোয়া করেন মাওলানা আব্দুর রহমান।
টেকনাফের মুচনি ক্যাম্পের মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের মূল দাবী সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরতে চাই। বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আমরা কৃতজ্ঞ।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণ ভাবে দাঁড়িয়ে নিজ দেশে বাড়ি ফিরার আকুতি জানিয়েছেন।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে একটি মহাসমাবেশ হয়। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তের গুলি নিহত হন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন স্বপ্ন দেখানো নেতা মুহিবুল্লাহ। ২০১৮ সালের দিকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে আবির্ভাব হয় মাস্টার মুহিবুল্লাহর। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত নিয়ে যেতে সংগঠিত করেছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ জোরালো জনমত গড়ে তুলেছিলেন।
তিনিই শুরু করেছিলেন ‘গুয়িং হোম’ ক্যাম্পেইন। কিন্তু প্রত্যাবাসন বিরোধী রোহিঙ্গাদের একটি চক্র ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকে সংগঠনের কার্যালয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি নিহত হবার পর এধরণের সমাবেশে একক কোনো আয়োজক কিংবা নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ সামনে আসছেন না। তবে প্রচারপত্রে আয়োজক হিসেবে ‘নির্যাতিত সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’ লেখা হয়েছে।
২০১৭ সালের আগস্টে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে নতুন করে পালিয়ে আসে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা। সরকারি হিসেবে এদের বর্তমান সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদেরকে উখিয়ার টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়। তাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ বিশাল বনভূমি হারিয়ে ফেলে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-