বাংলা ট্রিবিউন •
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার ছয় বছর পূর্ণ হলো শুক্রবার (২৫ আগস্ট)। কূটনৈতিক জটিলতায় আটকে আছে প্রত্যাবাসন। যদিও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছিল মিয়ানমার সরকার। কিন্তু সেই প্রত্যাবাসন আজো শুরু হয়নি। এতে দীর্ঘ হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। এরই মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা। সেইসঙ্গে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধ। সবমিলিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চয়তায় আতঙ্কে আছেন তারা। পাশাপাশি তিন দফায় রেশন কমিয়ে দেওয়ায় হতাশায় নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন তারা।
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশেষ করে প্রত্যাবাসনে কোনও অগ্রগতি হচ্ছে না। এ ছাড়া মিয়ানমার সেনাবাহিনী সবসময় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে চরম বৈরী মনোভাব পোষণ করে আসছে। ফলে মিয়ানমারের সামরিক শাসনামলে এই সমস্যার সমাধান নিয়ে শঙ্কিত তারা। তবে নিজ দেশে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা।
গত মে মাসে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহায়ক পরিবেশ ও পরিস্থিতি আছে কিনা, তা যাচাই করতে গিয়েছিল টেকনাফের রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি দল।
প্রতিনিধি দলের সঙ্গে থাকা রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘মিয়ানমারে আমরা খুব জুলুমের (নির্যাতন) শিকার হয়ে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। এখানে ছয় বছর শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কোনও কূলকিনারা হয়নি। দিন দিন ক্যাম্পের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফলে ছেলেমেয়েদের পাঠদান করাতে পারছি না। আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘকে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সে অনুসারে নিজ দেশে ফিরতে চাই। আমরা ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ফিরতে চাই না। মিয়ানমারে ১৩৫টি জনগোষ্ঠী আছে, তাদের মতো আমরা সেদেশে বাকি জীবন কাটাতে চাই, আমরা আমাদের অধিকার চাই।’
রেশন কমিয়ে দেওয়ায় ক্যাম্পের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে উল্লেখ করে মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘আমরা খুব দ্রুত প্রত্যাবাসন চাই। দাতা সংস্থাগুলো রেশন কমিয়ে দেওয়ায় অনেকে হতাশ হয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।’
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আবু সামা বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের জন্য গত কয়েক মাস আগে আমাদের মিয়ানমার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখে আসলাম আমাদের জন্য প্রস্তুত রাখা ক্যাম্পগুলো। ওই ক্যাম্পে যাবো না, আমাদের বসতভিটে ফিরিয়ে দিলে যাবো। মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনে আমরা শরণার্থী হয়ে ক্যাম্পে আছি। আবার সেদেশে গিয়ে শরণার্থী হতে চাই না। রাখাইনে ফেলে আসা বসতভিটায় রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা না হলে বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে থাকা কোনও রোহিঙ্গা ফিরতে রাজি হবে না।’
টেকনাফের লেদা ২৬ নম্বর ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘ক্যাম্পে দীর্ঘ ছয় বছর পার হয়ে গেলো। আমরা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত আছি। তবে ক্যাম্প থেকে মিযানমারে তৈরি করা ক্যাম্পে ফিরতে চাই না। আমরা সেদেশে গিয়ে কষ্টের জীবন চাই না। আমাদের নিজেদের গ্রামে নিয়ে গেলে, স্বেচ্ছায় চলে যাবো।’
তিনি বলেন, ‘এক হাজার ৪০ টাকা থেকে কমিয়ে এখন ৮৪০ টাকা রেশন দেওয়া হচ্ছে। তা নিয়ে আমাদের চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেকে অভাবের কারণে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এতে পাচারসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। ক্যাম্পে এত ঘনবসতি, কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে। এবার আমরা ফিরতে চাই। অন্তত বাকি জীবন নিজ দেশে কাটাতে চাই।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্যমতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্র্যাবাসন শুরর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল।
বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল গত মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১ জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর মে মাসে রাখাইন পরিস্থিতি দেখতে যান রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর শেষ হলেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা হয়নি।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রত্যাবাসনের কোনও বিকল্প নেই উল্লেখ করে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার সব সময় প্রস্তুত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে। রোহিঙ্গারা রাখাইনে নিজেদের ভিটে বাড়িতে যেতে চায়। তাদের নিরাপত্তা এবং নাগরিকত্বের দাবিও রয়েছে। তারা কোনোমতেই রাখাইনে নির্মিত মডেল ভিলেজে যেতে চায় না। সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার কিছু রোহিঙ্গাকে নিজেদের ভিটে বাড়িতে প্রত্যাবাসনের জন্য সম্মতি দিয়েছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চাই আমরা।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-