তুষার দেব •
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়েছে। রোহিঙ্গা কানেকশনে মিয়ানমারে উৎপাদিত মাদক ইয়াবা সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে দেশে ঢুকছে।
শুধুৃ তাই নয়, দেশের অভ্যন্তরে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন গন্তব্যে ইয়াবার ছোট-বড় চালান পৌঁছে দিতেও রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই রোহিঙ্গার বদৌলতে মরণনেশা ইয়াবা ব্যাপক হারে আসছেই।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও রোহিঙ্গা মাঝিদের সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মিয়ানমার থেকে মরণনেশা ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথসহ চোরাচালানের পণ্য দেশে নিয়ে আসার শীর্ষে রয়েছে রোহিঙ্গারা।
সীমান্তের উভয়পাড়ে দূর্গম পথঘাট তাদের চেনা। জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দেয়ার জন্য বিজিবির ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের নিয়ন্ত্রণেই চলছে মাদকের কারবার। নবী হোসেন বাহিনীর হাত ধরেই সীমান্ত পেরিয়ে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথের বড় বড় চালান ঢুকছে উখিয়া ও টেকনাফে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে প্রতি মাসে গড়ে পাঁচশ’ থেকে ছয়শ’ কোটি টাকা বাজারমূল্যের ইয়াবা ও আইস ঢুকছে।
নবী হোসেনের এই কারবারে সহযোগিতা দেয় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) আরও অন্তত নয়টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী। বিনিময়ে তারা পায় মাদক বিক্রির টাকার ভাগ।
গত পাঁচ বছরে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ, এপিবিএনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্তত অর্ধশতাধিক অভিযান চালিয়েও নবী হোসেন ও তার অন্যতম সহযোগী আবদুল হাকিমকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে একাধিক বন্দুকযুদ্ধে তাদের বাহিনীর অন্তত ১৫ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। এ কারণে সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও আইসের চালান নিয়ে আসা অনেকটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় সীমান্তের ওপার থেকে নিয়মিতভাবেই ইয়াবার চালান দেশে আসছেই।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে আমরা সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান অব্যাহত রেখেছি। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদসহ কয়েকজন সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মূল হোতারা মিয়ানমার সীমান্তে কিংবা টেকনাফের গহিন অরণ্যে অবস্থান করায় তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের তৎপরতা কেবল শরণার্থী শিবির কেন্দ্রিক। কিন্তু সীমান্ত তো আমরা পাহারা দিই না। গহীন অরণ্যে অবস্থান করে সন্ত্রাসীরা সীমান্তের উভয়পাড়ে আসা-যাওয়া করছে।
রোহিঙ্গাদের কারণেই মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে মাদকের কারবার বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) মুহাম্মদ আলী হোসেন।
তিনি বলেন, কম পুঁজিতে বেশি লাভের হাতছানি রয়েছে ইয়াবার কারবারে। লোভ সংবরণ করতে না পেরে পরিবহন শ্রমিক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এই কারবারে সহজেই জড়িয়ে পড়ছে। তবে সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমার থেকে দেশে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে রোহিঙ্গারাই। সীমান্তে মাদক চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ এখন অনেকটা তাদের হাতেই।
অপরদিকে, কক্সবাজারে ঢাকঢোল পিটিয়ে আত্মসমর্পণের পর জামিনে মুক্তি পাওয়া মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিদের অনেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফের মাদকের কারবারে জড়িয়েছে। আড়ালে থেকে তারাই মাদকের কারবারে অর্থলগ্নি করছেন।
এদের মধ্যে টেকনাফ-উখিয়ার সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদির ছোট ভাই টেকনাফের আলিয়াবাদের আবদুস শুক্কুর, একই এলাকার আমিনুর রহমান, পশ্চিম লেদা এলাকার নুরুল হুদা মেম্বার, উত্তর লেঙ্গুর বিলের দিদার মিয়া, মুন্ডার ডেইলের শাহেদ রহমান নিপু, মধ্য জালিয়াপাড়ার মোজাম্মেল হক, দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার জোবায়ের হোসেন, কুলালপাড়ার নুরুল বশর, সাবেক কাউন্সিলর নুরশাদ, শিলবুনিয়াপাড়ার কামরুল হাসান, ডেইলপাড়ার আবদুল আমিন, একই এলাকার নুরুল আমিন, চৌধুরীপাড়ার শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক, ফয়সাল রহমান, নাজিরপাড়ার এনামুল হক ওরফে এনাম মেম্বার, মৌলভীপাড়ার একরাম হোসেন, নাজিরপাড়ার সৈয়দ হোসেন, আলীর ডেইল এলাকার শাহেদ কামাল, সাবরাংয়ের মৌলভী বশির আহম্মদ, পুরাতন কল্যাণপাড়ার শাহ আলম, নাজিরপাড়ার আবদুর রহমান প্রমুখ রয়েছেন। বর্তমানে তারা প্রকাশ্যে এলাকায় অবস্থান করে পরোক্ষভাবে ইয়াবার কারবারে কলকাঠি নাড়ছেন।
গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলায়ের তালিকায় যে ৭৩ জন ইয়াবা গডফাদারের নাম ছিল, তাদের মধ্যে মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১২ জন। এর বাইরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ২৫ জন। ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে ৩৫ গডফাদার।
অভিযোগ রয়েছে, তালিকাভুক্ত ইয়াবার গডফাদারদের ধরতে এখন আর আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তেমন আগ্রহ নেই। তাই আত্মগোপনে যাওয়া গডফাদারদের অনেকেই ফিরে এসে এলাকায় নির্বিঘেœ ঘুরেও বেড়াচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ গত তিন দিনে টেকনাফের নাইট্যংপাড়া এবং নগরীর শাহ আমানত সেতু ও মেরিনার্স রোডে অভিযান চালিয়ে পৃথকভাবে দুই লাখ ইয়াবার চালান জব্দ করেছে কোস্টগার্ড ও ডিবি পুলিশ।
এর মধ্যে গত ১৪ জুন টেকনাফের নাইট্যংপাড়া এলাকা থেকে এক লাখ পিস ইয়াবার চালান জব্দ করে কোস্টগার্ড। সংস্থার পূর্ব জোনের অধীন বিসিজি টেকনাফ থানাধীন নাইট্যংপাড়া নাফ নদী সংলগ্ন এলাকায় একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে প্যারাবন থেকে বস্তাভর্তি অবস্থায় ইয়াবাগুলো জব্দ করে।
তার আগেরদিন অর্থাৎ গত ১৩ জুন ভোরে নগরীর শাহ আমানত সেতু ও ফিরিঙ্গী বাজার মেরিনার্স রোডে পৃথক অভিযান চালিয়ে এক লাখ ইয়াবাসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করে সিএমপির গোয়েন্দা (ডিবি) শাখা। ডিবির দক্ষিণ ও পশ্চিম বিভাগের দু’টি দল আলাদাভাবে এ অভিযান পরিচালনা করে।
এতে গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মো. কালু (৪৬) ও মো. শাহাবউদ্দিন ওরফে বাবুল (৩৭)। এর মধ্যে কালু পেশায় ট্রাকচালক। তার ট্রাকটিও জব্দ করা হয়েছে। তাদের দু’জনের কাছে ৫০ হাজার করে এক লাখ ইয়াবা পাওয়া যায়। তারা কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান দুটি চট্টগ্রামে এনে ক্রেতার হাতে তুলে দেয়ার কথা ছিল।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-